প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য স্থাপত্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন স্থপতি সাকিব – আনন্দ আলো

প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য স্থাপত্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন স্থপতি সাকিব – আনন্দ আলো

প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে স্থাপত্যের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন স্থপতি নাজমুস সাকিব তনু। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১৮ সালে মানব বসতি বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। তাঁর রয়েছে “স্থা-কল্প আর্কিটেক্টস” নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট ও কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যে তিনি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার নকশা করেছেন। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে এই স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন-মোহাম্মদ তারেক

যে কোনো স্থাপনা তৈরির সময় স্থানীয় নির্মাণ পদ্ধতি, উপকরণ- সরঞ্জাম ও জনবল ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দিলে প্রকল্প গুলি অনন্য বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, পাশাপাশি প্রকল্প তৈরিতে অনেক খানি সময় ও ব্যয় সাশ্রয় হয়। প্রকল্প গুলিতে অনেক গল্প তৈরি হয়, স্থানীয় মানুষ সেই প্রকল্পের স্মৃতিপট ও স্বত্ত্ব ধারণ করেন। প্রতিটি অঞ্চলের এমন স্বকীয় বৈশিষ্ট্য গুলো স্থাপত্যে তুলে আনতে আগামীর স্থপতিরা কাজ করবেন, এতে এই বাংলার স্থাপত্য আরও সমৃদ্ধ হবে। কথা গুলো বললেন স্থপতি নাজমুস সাকিব।
তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। স্কুল জীবনেই বাবাকে হারান। তার বাবা জহির উদ্দিন ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মাতা নাসিমা খাতুনও ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, ছবি আঁকা ও গান-বাজনার প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক ছিল। দাবা খেলায় প্রথম হাতেখড়ি হয় মাত্র ৫ বছর বয়সে মায়ের কাছ থেকেই। এরপরে দাবাগুরু লিয়াকত আলী খানের কাছে আধুনিক দাবায় প্রশিক্ষণ নেন। ২০০৫ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত টানা তিন বছর কুষ্টিয়া জেলা জুনিয়র দাবা চ্যাম্পিয়ন ও আন্তঃবিদ্যালয় দাবা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন।
২০০৭ সালে কুষ্টিয়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি ও ২০০৯ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করে ভর্তি হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে। ২০১৫ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় দাবাতে জাতীয় স্বর্ণপদক লাভ করেন এবং আন্তর্জাতিক রেটিং প্রাপ্ত হন। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে চালু করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দাবা ক্লাব। এর পাশাপাশি গড়ে তোলেন ‘সাধু-সংগ’-নামে বাউল ও লোক গানের দল। উদ্দেশ্য ছিল আমাদের শেকড়ের গানগুলির সাথে বাঁশি, ঢোল, মৃদঙ্গ, খোমক, একতারা, দোতারার মত দেশীয় বাদ্যযন্ত্রগুলির প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্ম সঙ্গীত অনুরাগীদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে খুলনায় মুরলী লোক সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে ওস্তাদ নিখিল কৃষ্ণ মজুমদারের কাছে বাঁশিতে উচ্চাঙ্গ ও লোকসংগীতের তালিম নেন।


সম্পর্কিত

স্থপতি নাজমুস সাকিব
স্থপতি নাজমুস সাকিব
কুষ্টিয়া পল্লী উন্নয়ন সংস্থা ভবন, বজলার মোড়

২০১৬ সালে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিন থেকে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে মানব বসতি বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (এমএসসিএইচএস)সম্পন্ন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও সিনিয়র এলামনাইদের সাথে বিভিন্ন স্থাপত্য প্রকল্পে সহযোগী হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা তাকে সার্বজনীন ও অংশগ্রহণ মূলক স্থাপত্যচর্চা নিয়ে ভাবতে শেখায়। স্নাতকোত্তর চলাকালীন সময়ে কোষ্টাল রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশনে গবেষণা সহযোগী স্থপতি হিসেবে খন্ডকালীন কাজও করেন। মানব বসতি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে তিনি উপলব্ধি করেন বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের সমাজ ও নগর গঠনে একজন স্থপতি ও স্থাপত্যের গুরুত্ব। পড়াশোনা শেষ করে নিজ জন্মভূমি কুষ্টিয়ায় ফিরে যান । ২০১৮ সালে নিজেই গড়ে তোলেন ‘স্থা-কল্প আর্কিটেক্টস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশের কোনো জেলা শহরে তিনিই সর্বপ্রথম একজন স্থপতি হিসেবে পূর্ণকালীন স্থাপত্যচর্চা শুরু করেন। স্থা-কল্প আর্কিটেক্টস প্রতিষ্ঠানকে তিনি আঞ্চলিক স্থাপত্য চর্চার এমন একটা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলছেন, যা কিনা দেশের অন্যান্য অঞ্চল গুলোর জন্যেও একটা উদাহরণ হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটিতে কুষ্টিয়া অঞ্চলের বেশ কয়েকজন নবীন স্থপতি তার সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। বিগত ৮-৯ বছরে প্রায় দুই শতাধিক স্থাপনার নকশা ও নির্মাণে স্থা-কল্প আর্কিটেক্টস যুক্ত হয়েছে। একক ও বহুতল আবাসিক ভবনের পাশাপাশি বিভিন্ন বাণিজ্যিক, শিল্প-কারখানা, স্বাস্থ্য-সেবা ভবন সহ সরকারি ও বেসরকারি অনেক গুলো প্রকল্পে করেছে প্রতিষ্ঠানটি। উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আল-সালেহ লাইফলাইনের মনিরা মেডিকেল এন্ড নার্সিং সেন্টার, কুষ্টিয়া ডিসি কোর্ট প্রাঙ্গণে জেলা বার এসোসিয়েশন বিল্ডিং, কুষ্টিয়া পল্লী উন্নয়ন সংস্থা ভবন, কুষ্টিয়ার এন এস রোডে স্থা-কল্প আর্কিটেক্টস অফিস, ওয়েস্ট কনসার্ন বাংলাদেশের তত্বাবধান ও বোরডা জার্মানির অর্থায়নে ইন্টিগ্রেটেড আরবান ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট এর অধীনে সাভার বলেশ্বরি নদীপাড়ের ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন, কুষ্টিয়া পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পাবলিক স্যানিটেশন প্রকল্প, কুষ্টিয়ার হরিনারায়নপুরে লক্ষন জুট মিলস্ ইন্ডাস্ট্রিজ এর লেবারস ভিলেজ ও এমটু ক্যাফে এন্ড রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। স্থপতি নাজমুস ‌সাকিব তনু বলেন, আমার লক্ষ্য বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীভূত স্থাপত্যচর্চার অনুপ্রেরণা তৈরি করা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল তথা সারা দেশের মানুষের কাছে স্থাপত্যের সর্বোচ্চ সেবা পৌছে দেওয়া। টেকসই ও সঠিক নির্মাণ কৌশলের পাশাপাশি উদ্ভাবনী এবং অংশগ্রহণমূলক নকশা পদ্ধতির মাধ্যমে মানসম্পন্ন নির্মিত পরিবেশ তৈরি করে কুষ্টিয়ার মতো প্রত্যন্ত শহরের নগরচিত্র গড়ে তোলা। নবীন স্থপতিরা তাদের নিজ এলাকায় বা জেলা শহরে ভালো কাজের পরিবেশ তৈরি করতে পারলে স্থাপত্যকে একটা মানবিক ও সামাজিক সেবা হিসেবে দেশের আপামর জনগণের কাছে পৌছে দেওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি। তিনি আরও বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নির্মিত পরিবেশ বা স্থাপনাগুলো বিজ্ঞান সম্মত হওয়ার বিকল্প নেই। যে কোনো স্থাপনার নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম প্রয়োজন সেই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও মুল্যায়ন। প্রতিটা পর্যায়েই ব্যবহারকারী ও দায়িত্বরতদের অংশগ্রহনে পরিকল্পনা প্রণয়ণ ও বাস্তবায়ন করা উচিত। স্থাপনার সার্বিক ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেয়াদ বিবেচনা করে পরিবেশ ও প্রাপ্তিভেদে উপযুক্ত নির্মাণ সামগ্রী ও উপকরণ বাছাই করতে হবে। ইমারত নির্মাণের সময় নির্ধারণ ও ব্যয় সামঞ্জস্যকরণ, নির্মাণে নিয়োজিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে সমন্বয়করণ ও নির্দেশনা প্রদান এবং নির্মাণাধীন সময়ে সৃষ্টি হওয়া সমস্যাগুলো সমাধানে সৃজনশীল ও বস্তুনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহন করাও একজন স্থপতির দায়িত্ব।” ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের মানুষদের স্থাপত্যের সঠিক সেবা প্রদান ও মুল্যবোধ তৈরিতে এই দেশের স্থপতিদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট, স্থপতিদের বিভিন্ন সংগঠন এবং স্থাপত্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ে নীতিগত ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে প্রান্তিক পর্যায়ে স্থপতিদের অংশগ্রণের পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করাটা অবশ্যিক বলে ব্যক্ত করেন। ব্যক্তি জীবন ও সমাজে স্থাপত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে এই স্থপতি বলেন, “খাদ্য ও বস্ত্রের পরেই মানুষের তৃতীয় মৌলিক চাহিদা বাসস্থান। এই বাসস্থানগুলো তৈরি হওয়া উচিৎ বাস্তুশাস্ত্র মেনে, যা কিনা সেখানে বসবাসরত মানুষের শারিরীক ও মানসিক সুস্থতা ও বিকাশকে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রন করে। পাশাপাশি যে কোন স্থাপনা একটি সমাজের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে বহিঃপ্রকাশ, লালন ও পালন করে।”

 

Scroll to Top