এ জেড এম আব্দুস সবুর
ত্যাগের মহিমায় এসেছে পবিত্র ঈদুল আজহা। এই ঈদের মহিমা পশু কোরবানি। বিশ্বের মুসলমানরা ইব্রাহীম (আ.) কর্তৃক তার পুত্র ইসমাইলকে (আ.) মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করার স্মৃতিকে ধারণ করতেই প্রতিবছর এই দিনে মহান আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করে থাকেন। এই কোরবানির সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে। তাই পশু সঠিক নিয়মে কোরবানি করা উচিত।
কোরবানি হলো আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের বিনম্র প্রকাশ। আল্লাহর বান্দা হিসেবে উচিত ছিল নিজের জীবন আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করা। কিন্তু সেটি সম্ভব না হলে অন্তত নিজের উপার্জিত অর্থে কেনা পশু (প্রাণ) আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করাই কোরবানির মূল কথা। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও ইসলামের নির্দেশনা হলো, পশুর উপর মানবিকতা ও দয়া প্রদর্শন করতে হবে।
পশু কোরবানি নিজ হাতে করাই উত্তম। মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামগণও নিজ হাতে কোরবানি করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেছেন। প্রতিবছরই তিনি কোরবানি করেছেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৪৪৯)। কোরবানি ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও যারা কোরবানি করে না, আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের ভর্ৎসনা করেছেন। আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তার কোরবানির পশুর উপর পা দিয়ে চেপে ধরে নিজ হাতে কোরবানি করতে দেখেছি।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১৫৫)
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) (কোরবানির আগে) ছুরি ধারালো করতে এবং তা পশুর দৃষ্টির অগোচরে রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন।’ ছুরি পশুর সামনে আনলে পশু ভয় পেয়ে যায়। এটি পশুকে কষ্ট দেওয়ারও শামিল। ‘তোমাদের কেউ জবাই করার সময় যেন তা দ্রুত সম্পন্ন করে (যাতে পশু অধিক পরিমাণে কষ্ট না পায়)।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১৭২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমরা যখন জবাই করবে, কষ্ট না দিয়ে জবাই করো, আর তোমাদের ছুরিগুলো খুব ভালোভাবে ধারালো করে নাও, যাতে তোমরা তোমাদের জবাইকৃত পশুকে আরাম দিতে পারো।’ (সহীহ মুসলিম)।
অনেক সময় দেখা যায়, আগে ভাগে গোশত খাওয়ার জন্য ঈদের নামাজের আগেই কোরবানি করে ফেলা হয়। অথচ ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করলে কোরবানি হবে না। জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করিম (সা.) কোরবানির দিন (প্রথমেই) নামাজ আদায় করেন। তারপর তিনি খুতবা দেন। এরপর (কোরবানির পশু) জবাই করেন। তিনি ঘোষণা দেন—নামাজের আগে যে ব্যক্তি পশু জবাই করবে, তাকে নামাজের পর আরেকটি পশু জবাই করতে হবে…।’ (বুখারি, হাদিস : ৯২৮, ৬৮৮৪)।
কোরবানির প্রাণীকে ক্ষুধার্থ বা পিপাসার্ত রাখা অন্যায়। জবাই করার আগে পশুকে ঘাস, পানি ইত্যাদি ভালোভাবে খাওয়াতে হবে। পশুকে কোরবানি করার স্থানে টেনে-হিঁচড়ে নেওয়া অন্যায়। একটি পশুকে আরেকটি পশুর সামনে জবাই করা যাবে না। জবাই করার জন্য পশুকে কঠোরভাবে শোয়ানোর বিষয়েও নিষেধ রয়েছে।
কোরবানি করার সময় পশুকে পশুর বাম কাতে শোয়াতে হবে। কোরবানির পশু শোয়ানোর পর যেন কিবলামুখী হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পশ্চিম দিকে যেহেতু কিবলা সেই হিসেবে পশ্চিম দিকে যাতে পশুর মুখ হয় সেদিকে আমরা খেয়াল রাখব। অর্থাৎ পশুকে বাম পাজরের উপর, দক্ষিণ দিকে মাথা দিয়ে কিবলামুখী করে শোয়াতে হবে। এভাবেই পশুকে শোয়ানো উত্তম। পশুটিকে এমনভাবে ধরতে বা বেঁধে নিতে হবে যেন জবাইয়ের সময় সে পাগুলো বারবার ছুড়তে না পারে।
পশু জবাই করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ছুরি চালানো শুরু করতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যেন পশু জবেহ করা না হয় সে বিষয়টি খেয়াল রাখা অবশ্য কর্তব্য। কোরবানির পশু এমনভাবে জবাই করা যাবে না, যার ফলে গলা পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায়। পশু জবাই করার সময় একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, পশুর খাদ্যনালী, শ্বাসনালী আর দুইপাশে থাকা দুটি নালী কেটে দেওয়া হয়। এ নালীগুলো কাটা হয়ে গেলেই পশু জবাই বিশুদ্ধ হয়ে যায়। অনেকেই গরু জবাই করতে গিয়ে ছুরি চালানোর পর ছুরির ধারালো বা সুঁচালো মাথা দিয়ে খোঁচাখুঁচি করেন, মেরুদণ্ডের সঙ্গে ঘাড় পর্যন্ত যে স্পাইনাল কর্ড রয়েছে, সেটির রগ কাটার জন্য চেষ্টা করেন। এ ধরনের খোঁচাখুঁচি কোনোক্রমেই উচিত নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে এভাবে খোঁচাখুঁচির ফলে পশুটি মৃত্যুর আগেই একবার হার্টফেল করে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত। পশুর প্রাণ বের হওয়ার আগে চামড়া ছাড়ানো যাবে না। (জাওয়াহিরুল ফিকহ : ২/২৭৩)।
লেখক: আইনজীবী
সারাবাংলা/এসবিডিই