ক্যাডার বৈষম্যের কারণে পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগের পাশাপাশি সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিতে যোগ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দ্রুত পদোন্নতির দাবি জানিয়েছেন বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফোরাম নামের একটি সংগঠন।
আজ রোববার বিকালে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা ও চিকিৎসা শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং অন্তঃ ও আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিতে যোগ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দ্রুত পদোন্নতির লক্ষ্যে আয়োজিত এক মতবিনিয় সভায় এ দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
এতে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির আহ্বায়ক ডা. মির্জা মো. আসাদুজ্জামান রতন, যুগ্ন আহ্বায়ক ড. মো. শামসুল আরেফিন, ডা. মো. বশির উদ্দীন, ডা. মো. ইকবাল হোসাইন, ড. মো. কায়সার ইয়ামিদ ইষাদ. ড. মো. খায়রুল ইসলাম, ড. মো. আশরাফুল আলম সুমন, সদস্য সচিব ড. মো আল আমিন।
মতবিনিয়ম সভায় লিখিত বক্তব্যে সংগঠনটির নেতারা বলেন, ‘বাংলাদেশের নানা বিষয়ে কর্মরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ তাদের সবটুকু পরিশ্রম ও সততা নিয়ে এদেশের মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন এবং এ সরকারের দেশ বিনির্মানে সর্বদা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ দেশের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য প্রশাসন স্বাস্থ্য খাতকে গত একদশকেরও বেশি সময় করাল গ্রাসে নিমজ্জিত করে ভঙ্গুর দশায় পরিণত করেছে। সে কারণে ২৬টি ক্যাডারদের মাঝে স্বাস্থ্য ক্যাডারকে সবচেয়ে বেশী নিগৃহীত ও অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে।’

বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ার কারণ উল্লেখ করে নেতারা বলেন, ‘স্বাস্থ্য প্রশাসন বিসিএস ব্যাচ ভিত্তিক পদোন্নতি না দিয়ে, ‘পদ নাই-পদোন্নতি নাই’ নীতি মেনে চলা। নতুন নতুন মেডিক্যাল ডেন্টাল কলেজে শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি এবং পুরনো মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক অনুপাতে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও নতুন পদ সৃষ্টি না করা। চিকিৎসক নেতারা নবীন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বরাবরই হেলাফেলার দৃষ্টিতে দেখে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির জন্য যে ভর্তি পরিক্ষা হয়ে থাকে, সেখানে বাস্তবতার নিরিখে আসন সংখ্যা নির্ধারিত হয় না। সেবাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে সেবক উপেক্ষিত।’

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফোরামের আহ্বায়ক ডা. মির্জা মো. শামসুল আরেফিন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত। অন্য ক্যাডারে থাকা আমাদের জুনিয়র ব্যাচের কর্মকর্তরাও পদে আমাদের সিনিয়র। এটা আমাদের জন্য একটা মানসিক পীড়ার কারণ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দীর্ঘদিন মেডিকেল অফিসার পদে আটকে থাকা চিকিৎসকদের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির দাবি জানাচ্ছি। এতে সরকারের আর্থিক কোনো চাপ পরবে না। কারণ আমরা ইতিমধ্যে ওই বেতন পাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন যাবত এই দাবি জানিয়ে আসছি। তবে আশ্বাস ছাড়া কোনো কিছুই পাইনি। জনগণের ভোগান্তি হয় এমন কোনো কর্মসূচিতে আমরা যাবো না। আমরা মানুষকে জিম্মি করে দাবি-দাওয়া আদায় করবো না।’
মেধার অপচয়ের কথা উল্লেখ করে ডা. শামসুল আরেফিন বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের নেতারা ইচ্ছে হয়েছে মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছে। এসব শিক্ষার্থীদের কে পড়াবে সে চিন্তা কেউ করেনি। আমাদের কোয়ালিটি চিকিৎসক প্রয়োজন। সঠিক স্থানে সঠিক লোক নিয়োগ প্রয়োজন। একজন কার্ডিওলজি সার্জনকে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে প্যারাসিটামল লেখার জন্য বসিয়ে রেখেছে। এটা মেধার অপচয়। মেধার মূল্যায়ন না হলে মেধাবিরা দেশত্যাগ করে। তখন আমাদের কতজনের সামর্থ্য রয়েছে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করার। আমরা দেশের মানুষকে সেবা দিতে চাই। আমরা চাইনা বাংলাদেশের রোগীরা অন্য দেশ মেডিকেল টুরিজমের হাতিয়ার হোক।’
স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের দাবি দাওয়া নিয়ে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের দেখা করে আমাদের সুপারিশ জানিয়েছি। আমরা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়) অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান স্যারের সাথে কথা বলেছি। তিনিও আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।’
যুগ্ম-আহ্বায়ক ডা. বশির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা আর্থিক সুবিধা চাচ্ছি না। আমরা শুধু আমাদের সম্মান চাচ্ছি। যারা রাষ্ট্র কাঠামো ঠিক করে তারা এই সমস্যাটা তৈরি করেছে। আমাদের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরতরা যদি চিকিৎসক হতেন তাহলে হয়তো তারা আমাদের ওয়োন করতেন। তারা আমাদের দুঃখ বুঝতে পারতেন। বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে প্রশাসন ক্যাডারের যারা আছেন, তারা এদেশে চিকিৎসা নেন না। তাদের সন্তানরাও এদেশে থাকেন না।’
বাংলাদেশের এমবিবিএস ডিগ্রির মান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের এমবিবিএস ডিগ্রির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হুমকিত মুখে। এর কারণ চিকিৎসক সংকট। আর এ সংকটের কারণ চিকিৎসকদের সময় মতো পদোন্নতি না হওয়া। নিয়ম অনুযায়ী মেডিকেল কলেজে শিক্ষক-শিক্ষার্থী রেসিও হবে ৩০:১। কিন্তু আমাদের তা হচ্ছে না। কারণ পদ নেই বলে বিশেষজ্ঞদের পদোন্নতি হচ্ছে না।’
বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফোরামের চার দফা সুপারিশ
১. যেহেতু পদোন্নতি প্রার্থীর সংখ্যা এত বেশি যে শুধুমাত্র পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে বর্তমান সংকট হতে উত্তরণ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে জনগণের চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে নানা বিষয়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক নতুন পদ সৃষ্টি করা।
২. সম্ভাব্য নতুন পদের জন্য বর্তমানে আবেদনকারীদের মধ্য থেকে অধিক সংখ্যায় ভূতাপেক্ষভাবে পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি/সুপারনিউমারারি/ইন সিটু পদোন্নতি দিয়ে বিদ্যমান জট কমিয়ে জনগণের স্বাস্থ্য সেবার পথ সুগম করা।
৩. সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সকল বিষয়ে দ্রুত ও জরুরি ভিত্তিতে সকল বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে ভূতাপেক্ষভাবে সুপারনিউমারারি পদোন্নতি ও প্রয়োজনে ইন সিটু পদোন্নতি।
৪. যেহেতু প্রতিবছর অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অবসরে যান এবং মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে মেডিকেল শিক্ষার্থী এবং পোস্ট গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পায়, সেহেতু প্রতি বছর অন্তঃত দুইবার পদোন্নতির নিয়ম চালু করা এবং আন্তঃ ও অন্তঃ ক্যাডার বৈষম্য কমিয়ে আনতে একটি যুগোপযোগী পদোন্নতি নীতিমালা প্রনয়ন করা।