আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয়ে স্থাপত্য শিল্পে দেশের জন্য সৃষ্টিশীল কাজ করে চলেছে ‘ম্যাভেরিক আই আর্কিটেক্টস’। এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং পার্টনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন স্বনামধন্য স্থপতি রুহান ইসলাম জিনো এবং পার্টনার হিসেবে আছেন স্থপতি রাইয়ান ইসলাম শান্তনু ও স্থপতি সাদমিন সাদিয়ানা। স্থাপত্য চর্চার পাশাপাশি সাদমিন নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগে পার্ট—টাইম সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কর্মরত আছেন। আর জিনো ও শান্তনু ত্রিমাত্রিক স্থাপত্য ভিজ্যুয়ালাইজেশন কাজে দক্ষতার জন্য দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে এই তিন স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন- মোহাম্মদ তারেক
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ম্যাভেরিক আই আর্কিটেক্টস এর লক্ষ্য ছিল গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে থেকে উদ্ভাবনী, নান্দনিক, কার্যকর এবং টেকসই স্থাপত্যে সমাধান প্রদান করা, যেখানে ব্যবহারকারীদের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং নির্মাণ বিধি ও পরিবেশ বান্ধব বিবেচনাগুলি মানা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের স্থপতি রুহান ইসলাম জিনো এবং স্থপতি রাইয়ান ইসলাম শান্তনু তারা আপন ভাই। জিনো বড় এবং শান্তনু ছোট।
সম্পর্কিত
২০০৬ সালে স্থপতি রুহান ইসলাম জিনো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। স্থপতি রাইয়ান ইসলাম শান্তনু এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ২০১০ সালে। স্থপতি রুহান ২০১৩ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম সাদিয়া শবনম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করে ইউএনডিপিতে কর্মরত ছিলেন। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান ইলহাম জায়ীন। স্থপতি রাইয়ান ইসলাম শান্তনু ২০১২ সালে বিয়ে করেন স্থপতি সাদমিন সাদিয়ানাকে। তাদের একমাত্র সন্তান রিয়ানা শেহজীন। স্থপতি সাদমিন সাদিয়ানা চার ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। ২০১০ সালে তিনি এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে স্থপতি সাদমিন সাদিয়ানা ২০১৬ সালে দি ইউনিভার্সিটি অফ হংকং থেকে আরবান ডিজাইনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে এই স্থপতি ম্যাভেরিক আই আর্কিটেক্টস এ কাজ করার পাশাপাশি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগে পার্ট—টাইম সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কর্মরত আছেন।
ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করার পর স্থপতি শান্তনু প্রথমে ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ নামক প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন এবং স্থপতি সাদমিন সাদিয়ানা ‘ডি ডব্লিউ এম ফোর’ নাম স্থাপত্য পরামর্শক ফার্মে যোগ দেন। স্থপতি রুহান ইসলাম জিনো ২০০৭ সালে দুই জন সিনিয়র স্থপতির ফার্ম ‘ম্যাভেরিক আই’ এ যোগ দেন। পরবর্তীতে উক্ত সিনিয়র স্থপতিদ্বয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলে, স্থপতি জিনো ২০১৭ সালে ‘ম্যাভেরিক আই আর্কিটেক্টস’ নামে সেই ফার্মকে পুর্নগঠন করে ম্যানেজিং পার্টনার হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং একই সময়ে স্থপতি সাদমিন সাদিয়ানা এবং স্থপতি রাইয়ান ইসলাম শান্তনু পার্টনার হিসেবে যুক্ত হন। এর পাশাপাশি স্থপতি জিনো এবং স্থপতি সাদমিন বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট এর বিভিন্ন কমিটিতে স্থপতিদের পেশাগত বিষয়ে গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করে আসছেন।
‘ম্যাভেরিক আই আর্কিটেক্টস’ ইতোমধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হাসপাতাল, ফ্যাক্টরি, বাণিজ্যিক ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, বাংলো, পর্যটন এরিয়া প্রকল্পে ডিজাইন পরামর্শ দাতা হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি অসংখ্য রেসিডেন্সিয়াল ও কর্মাশিয়াল স্পেসের ইন্টেরিয়র ডিজাইন করেছে। তাদের উল্লেখযেযাগ্য স্থাপত্য ডিজাইন কাজের মধ্যে রয়েছে প্রগতি সরনিতে ইন্ট্রাকো কনভেশন সেন্টার, চট্টগ্রামে বিএনবিএসএস শপিং কমপ্লেক্স ও আর নিজাম রোডে আটলান্টা ট্রেড সেন্টার, নাসিরাবাদে জেবিএল ভারবেনা, সিলেটে বার ভুইয়া সিদ্দিক প্লাজা, ঢাকার কাকরাইলে অরোরা স্পেশালাইজড হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ইপিজেডে সিটেক্স লিমিটেড ফ্যাক্টরি, কোয়ালিটেক্স ফ্যাক্টরি ভবন, টংগীতে ক্যাপিটা জুয়েল কমপ্লেক্স, কুমিল্লায় ইন্ট্রাকো হাদিয়া টাওয়ার, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় কান্ট্রি ভিলা, জেসিএক্স এমএম ভিলা, কান্ট্রি হাউজ কিনারা, উত্তরায় সিপিডিএল হুসনা প্যালাডিয়াম ও আমেনা হাইটস, নিকুঞ্জে ক্যাপিটা ন্যান্সি, গোপালগঞ্জে ফেমাস ফোর ফ্যামিলি ভিলা, কুয়াকাটায় সিভাইন ট্যুরিজম সিটি, কক্সবাজারে ওরিয়ন ট্যুরিজম সিটি, ইউনিইয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেড হেড অফিসের ইন্টেরিয়র, এনবিআর ন্যাশনাল উইন্ডো প্রজেক্ট অফিসের ইন্টেরিয়র, এমইএস কনভেনশন হলের ইন্টেরিয়র, এনআরবি ব্যাংক গুলশান হেড অফিসের ইন্টেরিয়র ইত্যাদি। বর্তমানে ঢাকার বসুন্ধরা, উত্তরা, ধানমন্ডি, গুলশান, জলসিড়ি আবাসন সহ অনেক জায়গায় তাদের বেশ কিছু নতুন আর্কিটেকচারাল ও ইন্টেরিয়র প্রজেক্টের কাজ চলমান আছে। এছাড়াও তারা ২০১৮ সালে আইএবি—ডিপিডিসি কতৃর্ক আয়োজিত আর্কিটেকচার জিজাইন প্রতিযোগিতায় বিশেষ সম্মাননা (প্রথম) পুরস্কার অর্জন করে।
স্থপতি রুহান ইসলাম জিনো বলেন, ম্যাভেরিক আই আর্কিটেক্টস এর নাম এসেছে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে স্থাপত্যকে দেখা ও উদ্ভাবনা করার সাহসিকতা থেকে। এটি শিল্পে সৃজনশীলতা এবং স্বাধীন চিন্তার পথিক হিসেবে আমাদেরকে পরিচয় দেয়। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান এবং দেশের মানুষের পারিপার্শ্বিক আর্থসামাজিক পরিস্থিতি স্থপতি হিসেবে আমাদেরকে সব সময় একটি চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয়। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে অনন্য ও আধুনিক স্থাপত্য তৈরির প্রযোজনীয়তার পাশাপাশি দেশের মাটি, জলবায়ু, মানুষের আর্থিক অবস্থা ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে সামঞ্জস্যতা রেখে স্থাপত্য চর্চা করাই আমাদের প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। স্থপতি রাইয়ান ইসলাম শান্তনু জানান, ছোট বা বড়, বাহ্যিক কাঠামো বা অভ্যন্তরীন সাজসজ্জা, যে কোনো প্রকল্পেই আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকে ব্যবহারকারিদের আর্থিক, পারিবারিক ও সামাজিক চাহিদাকে প্রাধান্য দেয়া। এর পাশাপাশি প্রচলিত ইমারত নির্মাণ আইন ও বিধিমালার মেনে নকশা প্রণয়ন করা, যেখানে বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও প্রকৃতির গুরুত্ব প্রতিফলিত হবে। আমরা প্রকল্পের ফাংশন ও চাহিদা যথার্থভাবে উপলদ্ধি করে পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় রেখে টেকসই নির্মাণে উপযুক্ত নির্মাণ সামগ্রী ও পদ্ধতি বাছাই ও প্রয়োগের মাধ্যমে নান্দনিক আধুনিক স্থাপত্য শৈলী উপহার দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থপতি সাদমিন সাদিয়ানা বলেন, সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা, পেশাগত দায়বদ্ধতা ও সৃষ্টিশীলতার পাশাপাশি ক্লায়েন্টদের সাথে সব সময় যোগাযোগ রাখা এবং কমিটমেন্ট পরিপূর্ণ করার মাধ্যমে সর্ব সাধারনের জন্য গ্রহণযোগ্য ও কার্যকরী প্রকল্প প্রণয়ন আমাদের অভিষ্ট লক্ষ্য। ভবিষ্যতে ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিষয়টি মাথায় রেখে আরবান ডিজাইন প্রণয়ন করা ও আবাসন সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে চাই। পাশাপাশি পূর্বাচল, উত্তরা ও ঢাকার পশ্চিমাংশে যে সকল আবাসিক এলাকা গুলো গড়ে উঠেছে সেখানে কন্টেক্সট সেনসিটিভ বা স্থানীয় প্রেক্ষিতের সাথে সংবেদনশীল আধুনিক স্থাপত্য ডিজাইন করার ইচ্ছা আছে। একই সঙ্গে পরিবেশ বান্ধব ইমারত ডিজাইন (গ্রীন বিল্ডিং) এ ভূমিকা রাখার পরিকল্পনাও রয়েছে আমাদের। স্থাপত্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক বাংলাদেশের তরুণদের জন্য ম্যাভেরিক আই আকিটেক্টস এর অনুপ্রেরণাদায়ক পরামর্শ হচ্ছে, স্থাপত্য কেবল একটি পেশা নয়, এটি সৃজনশীলতা, নান্দনিকতা এবং প্রযুক্তির মেল বন্ধন। বিদেশী স্থাপনাকে অনুকরণ না করে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশীয় স্থাপত্যের ভাষা উজ্জীবিত করে অনবদ্য নিজস্ব স্থাপত্য তৈরি করতে হবে।
বর্তমানে স্থাপত্য একটি বহুমুখী বিষয় যার মধ্যে ডিজাইন পরামর্শ, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, বিআইএম ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাদান, গবেষণা, ৩ডি স্থাপত্য, ভিজ্যুয়ালাইজেশন ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। আমাদের দেশের দ্রুত বর্ধমান নগরায়ন এবং আধুনিক স্থাপত্যের চাহিদা নতুনদের জন্য অসংখ্য সুযোগ নিয়ে আসছে। স্থাপত্য শিল্পের মাধ্যমে তরুণেরা সমাজের একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবেন, টেকসই এবং পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্যের মাধ্যমে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎকে আরও উন্নত করতে পারবেন।