ধূসরে সবুজ : দুই বন্ধুর স্থাপত্য ভাবনা – আনন্দ আলো

ধূসরে সবুজ : দুই বন্ধুর স্থাপত্য ভাবনা – আনন্দ আলো

দেশপ্রেম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে স্থাপত্যশিল্পে এ দেশের জন্য সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছেন স্থপতি মো: তৌহিদুর রহমান রিংকো ও স্থপতি ঈমানা হক। তারা বন্ধু এবং স্বামী স্ত্রী। দুজনেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে পড়াশোনা করেছেন। তাদের রয়েছে ‘গ্রীন এট্ গ্রে আর্কিটেক্টস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন স্থপতি মো: তৌহিদুর রহমান ও স্থপতি ঈমানা হক। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার নকশা করেছেন। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে স্বামী-স্ত্রী দুজনকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

স্থপতি মো: তৌহিদুর রহমান রিংকোর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। তার বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহ শহরে। রিংকোর বাবার নাম শামসুদ্দিন তালুকদার। তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। মা তাসলিমা তালুকদার গৃহিনী। চার ভাই বোনের মধ্যে মেঝ স্থপতি মো: তৌহিদুর রহমান। স্কুল, কলেজ জীবনে তিনি বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, হাতের লেখা, সায়েন্স ক্লাব প্রভৃতি কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে ২০০২ সালে এসএসসি ও ২০০৪ সালে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে। ২০১০ সালে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাশ করে বের হওয়ার পরপরই তিনি যোগ দেন অনুভূ আর্কিটেক্টস-এ। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর ডিজাইন ল্যাব আর্কিটেক্টস এ যোগ দেন। ২০১২ সাল পর্যন্ত সেখানে তিনি কাজ করেন।
তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় স্থপতি ঈমানা হক। তাঁর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। কিন্তু তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। ঈমানা হকের বাবার নাম আশরাফুল হক। তিনি একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক। মা শামীমা আশরাফ গৃহিনী।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ঈমানা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ছবি আঁকাআঁকি করতেন। অভিনয় ছিল তার পছন্দের বিষয়। ছায়ানটে গান শিখেছেন। কঁচিকাঁচার মেলার সাথে জড়িত ছিলেন। ছোটদের নাটকে অভিনয় করতেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। পরবর্তীতে আর্কিটেকচারের তার প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। সেই ভালোবাসা থেকে তিনি হয়েছেন সফল একজন স্থপতি।
ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০০২ সালে এসএসসি ও ২০০৪ সালে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে। ২০১০ সালে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাশ করে বের হওয়ার পর পরই তিনি যোগ দেন ‘স্টুডিও ম্যানিফোল্ড’ ফার্মে। ১ বছর কাজ করার পর তিনি ‘নির্ণয় উপদেষ্টা’ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। ২০১৩ সালে স্থপতি তৌহিদুর রহমান স্ত্রী স্থপতি ঈমানা হককে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘গন্ন এট্ গ্রে আকিটেক্টস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালে ঈমানা হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
গ্রীন এট্ গ্রে আর্কিটেক্টস-এর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরায় ডিএলএলএসএ টাওয়ার, গুলশানে হামিদা মঞ্জিল, চট্টগ্রামের টাইগার মিউজিয়াম, গাজীপুরে গোল্ডেন লাইন এক্সসোসেরিস ফ্যাক্টরি, ময়মনসিংহে প্রগতি টাওয়ার, ময়মনসিংহে রয়েল মিডিয়া কলেজ, ধানমন্ডিতে প্যারাগন কনভেনশন সেন্টার, মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে হিজল তলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, নারায়নগঞ্জে মেট্রোনিটিং লিমিটেডের ইন্টারন্যাশনাল বাইয়ার লাউঞ্জ, মাই টিভির ইন্টেরিয়র কাজ, তেজগাঁও-এ ঢাকা পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এর অধিভুক্ত হোটেল মেনেজম্যান্ট ইনস্টিটিউট এর ইন্টেরিয়র, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় আগোরা সুপার শপের ইন্টেরিয়র সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও বেশ কিছু ফ্যাক্টরি ডিজাইনের সঙ্গে জড়িত আছেন তারা।


সম্পর্কিত

স্থপতি মো: তৌহিদুর রহমান রিংকো ও স্থপতি ঈমানা হক

স্থপতি মো: তৌহিদুর রহমান বলেন, সহজ সরল স্থাপত্য আমাদের কাজের মূল বৈশিষ্ট্য। স্থাপত্যকে শুধুমাত্র উচ্চ মার্গের শিল্প অথবা নান্দনিকতার ব্র্যাকেটে বন্দি না রেখে একে ব্যবহারিক শিল্প হিসেবে দেখার চেষ্টা করি আমরা। সেক্ষেত্রে স্থাপনার ব্যবহারিক দিককে প্রাধান্য দিয়ে এমন স্থাপত্য নির্মাণে আমরা মনোযোগী যা কিনা একই সাথে নান্দনিক ও ব্যবহারিক। যা কিনা স্থাপনার ভেতর এবং বাহিরের অর্থপূর্ণ স্থানিক যোগযোগ তৈরি করে এবং সেই সাথে আর্থসামাজিক বাস্তবতা ও পরিবেশগত মানদন্ডে কার্যকরী হয়। পাশাপাশি নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কাছে স্থাপত্যকে কিভাবে আরো বেশি পৌছে দেয়া যায় সেই লক্ষ্যপূরণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় স্থাপত্য পেশা এখনো সর্বসাধারনের দোড় গোড়ায় পৌছাতে পারেনি। স্থাপত্য এখনো অনেকটা উচ্চবিত্ত এবং রাজধানী সহ ২-১টি বড় শহর কেন্দ্রিক। অথচ ক্রমবর্ধনশীল জনসংখ্যার এই দেশে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থাপত্যচর্চাকে রাজধানী থেকে মফস্বল, মফস্বল থেকে গ্রাম অবধি ছড়িয়ে দেয়াটা খুবই জরুরী। গণমানুষের জন্য স্থাপত্য এই ভাবনাটি আমাদের সর্বধরনের স্থাপত্য চিন্তা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জুড়ে থাকে।
আমরা চাই স্থাপত্য শুধুমাত্র একটি বিশেষ বিত্তশ্রেণীর কথা না বলুক। আমরা চাই স্থাপত্য জনমানুষের হোক, আমাদের লক্ষ্য দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, মফস্বল শহর গুলোতে স্থাপত্যচর্চাকে ছড়িয়ে দিতে। তবেই দেশ গঠনে স্থাপত্যচর্চা তার ভূমিকা রাখতে পারবে। আর সেই লক্ষ্যে আমরা রাজধানী ঢাকার বাইরে আমাদের কাজের পরিধিকে নিয়ে গেছি এবং স্থাপত্যের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিভাষার সাথে মধ্যবিত্তের চিন্তা, মনন ও চাহিদার একটি যোগসূত্র তৈরীর চেষ্টা করছি। এছাড়াও বৃহত্তর দিক থেকে দেখতে গেলে স্থাপত্য ও স্থাপনার নান্দনিকতা, স্থাপনার স্থায়িত্ব ও নির্মাণ ব্যয়, প্রতিবেশ ও পরিবেশের উপর স্থাপনার প্রভাব এই বিষয়গুলোর আমাদের স্থাপত্য ভাবনার পুরোটা জুড়েই থাকে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি ঈমানা হক ও তৌহিদুর রহমান বলেন, মানুষের জন্যই স্থাপত্য, স্থাপত্যের জন্য মানুষ নয়। এই বক্তব্যকে মননে ধারণ করেই আমরা বাংলাদেশের স্থাপত্যকে গণমানুষের কাছে পৌছে দিতে চাই এবং একই সাথে পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যের ব্যাপারে সমাজের প্রতিটি শ্রেণীকে সচেতন করার লক্ষ্যে কাজ করে যেতে চাই। স্থাপত্য মানুষের কথা বলুক, স্থাপত্য পরিবেশের কথা বলুক, স্থাপত্য এই পৃথিবীর কথা বলুক, স্থাপত্য আমাদের হোক।

Scroll to Top