দেশের সম্ভাবনাময় ওষুধ শিল্পে প্রয়োজন আরও নীতি সহায়তা | চ্যানেল আই অনলাইন

দেশের সম্ভাবনাময় ওষুধ শিল্পে প্রয়োজন আরও নীতি সহায়তা | চ্যানেল আই অনলাইন

অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রয়োজনীয় ঔষধের চাহিদা পূরণ, ক্যান্সারসহ জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ঔষধ উৎপাদন এবং বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন তৈরির অভুতপূর্ব সক্ষমতার মধ্যে দিয়ে গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ঔষধ শিল্প খাত চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করেছে বললে ভুল হবে না।

অথচ দু’দশক আগেও আমাদের দেশ ছিল বিদেশি ঔষধের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। আমদানীর পাশপাশি বেশিরভাগ ঔষধই বিভিন্নভাবে বিদেশ থেকে আনা হতো। একটি প্রয়োজনীয় ঔষধ সংগ্রহের জন্য এ ফার্মেসি ও ফার্মেসি ঘুরতে ঘুরতে হতে হতো। সময় নষ্ট হতো। ঔষধ পেলেও উচ্চ দামের কারণে হতাশও হতে হতো।

কিন্তু বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ঔষধ তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছে দেশের স্থানীয় ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

শুধু এই নয়, দেশে উৎপাদিত ঔষধ এখন ১৫০টিরও বেশি দেশে রফতানিও হচ্ছে। ঔষধ রফতানির ক্রমশবৃদ্ধি এই খাতের সুখ্যাতি ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্ব দরবারে। এমন কী আমেরিকা, ইউরোপেও ওষুধ রপ্তানি শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির উৎপাদিত ঔষধ বিদেশে রপ্তানি করে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে বাংলাদেশ।

ঔষধ শিল্পখাতের অন্যতম সাফল্য হলো ক্যান্সার, কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন জটিল ও বিরল রোগের ঔষধ দেশে উৎপাদন এবং প্রাপ্যতা সহজ করা। এর ফলে রোগীদের বিদেশমুখীতাও অনেক কমে এসেছে। একসময় ক্যান্সার, কিডনি, লিভার, ফুসফুসের কার্যকর কোনো ঔষধ ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এখন দেশের বাজারে এসব রোগের চিকিৎসায় কোনো ধরনের ঔষধের ঘাটতি নেই।

ঔষধ বিশেষজ্ঞদের ভাষায় এসব রোগের চিকিৎসায় মানসম্পন্ন ঔষধ উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। ঔষধ শিল্পের এই সক্ষমতা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।

ঔষধ শিল্প খাতে নতুন নতুন বিভিন্ন ধরনের জীবনরক্ষাকারী উচ্চমানের ভ্যাকসিন উৎপাদন ঔষধ শিল্পখাতকে রীতিমতো মর্যাদার আসনে আসীন করেছে।

আগে একটি প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনের জন্যে আমাদের বিদেশের দিকে হাত পেতে থাকতে হতো। কিন্তু এখন সেই সব ভ্যাকসিন আমাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে এবং সাশ্রয়ী মূল্যে জনগণের কাছে দিতে পারছে। এটি এক ধরনের রেভিউলিশন বললেও ভুল হবে না।

দেশেই এখন র‌্যাবিস, র‌্যাবিস-আইজি, হেপাটাইটিস বি, টাইফয়েড, টিটেনাস, টিটেনাস-আইজি, মিজেলস-রুবেলা, এন্টিভেনাম, ফ্লু ও মেনিনজাইটিস, প্যালিলোভাক্সসহ নানান ধরনের ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে।

এটি সম্ভব হয়েছে দেশের ফার্মাসিস্ট, কেমিস্ট, বায়োকেমিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট, চিকিৎসক, প্রকৌশলী সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে। অনেক কোম্পানিই এখন বিশ্বমানের ভ্যাকসিন উৎপাদন করার সক্ষমতা দেখিয়েছে-যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকর্তৃকও প্রশংসিত হয়েছে।

ঔষধ শিল্প খাতের আরেকটি সাফল্য হলো নতুন নতুন শিল্প ও কল-কারখানা স্থাপনের মধ্যে দিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থান তৈরি বেকারত্ব রোধে বড় ধরনের প্রভাব রাখছে। বিশেষ করে ঔষধের কারখানাগুলোতে এখন প্রচুর তরুণ-তরুণী ঔষধ উৎপাদনের সাথে জড়িত। এই খাতে নতুন নতুন শিল্পকারখানা নির্মাণ আমাদেরকে বড় আশাবাদী করে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের ঔষধ শিল্পও মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়েছিল। সে সময় ১৯টির বেশি কারখানাতে শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে।

তখন বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল শ্রমিকরা বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবিতে আইন বহির্ভূতভাবে আন্দোলন ও বিক্ষোভ করছেন।

পরবর্তীতে বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির নেতৃবৃন্দের তাৎক্ষণিক উদ্যোগ, সুচিন্তিত হস্তক্ষেপ, শ্রমিকদের সাথে ধারাবাহিক সভা এবং শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হলে ঔষধ শিল্পখাতে স্বস্তি নেমে আসে।

ঔষধ শিল্প খাতের মালিকপক্ষ সবসময়ই বলে আসছেন যেকোনো খাতের তুলনায় এই খাতের শ্রমিকরা সবচেয়ে ভালো বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন। এই শিল্পখাতে কাজের পরিবেশও ভিন্ন। অন্যান্য খাতের তুলনায় তাদের চাকরির সুরক্ষাও বেশি।

তবে শিল্পখাতের সবচেয়ে বড় যে ঝুঁকি বেড়েছে তা হলো ধারাবাহিকভাবে কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮ শতাংশ ঔষধ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে, বাদবাকি ২ শতাংশ উচ্চ প্রযুক্তির ঔষধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু ঔষধ উৎপাদনের কাঁচামাল ও মোড়কসামগ্রীর-এর অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

বিভিন্ন সূত্র মতে, ঔষধ শিল্পের বর্তমান বাজার ৩০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ঔষধ রফতানি করে আয় হচ্ছে ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ঔষধ শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে হলে এই মুহূর্তে প্রয়োজন টেকসই এপিআই খাতের বিকাশ, দীর্ঘমেয়াদী ঋণ প্রদান, শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান, অবকাঠামো নির্মাণ। অবশ্য সর্বশেষ বাজেটে এপিআই উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহিত সুবিধার মেয়াদ ৩০ জুন ২০২৭ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।

শত সম্ভাবনার এই শিল্প ঘিরে আরও কিছু সমস্যাও রয়ে গেছে। সম্ভাবনাময় এই শিল্পের বাজার সম্প্রসারণ এবং এর বিভিন্ন সমস্যা দেখভাল করার জন্য যে দক্ষ লোকবল প্রয়োজন সেখানে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

এদিকে ভেজাল, মানহীন ও নকল ওষুধ এই শিল্পের জন্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড় বড় কোম্পানিগুলো যখন সর্ব প্রচেষ্টা দিয়ে ঔষধের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করে বিশ্ব বাজারে নিজেদেরকে বিস্তৃত করছে, তখন মানহীন নকল ঔষধ জনজীবনে নানান ধরনের আশংকা তৈরি করছে। মানহীন ঔষধের নেতিবাচক প্রভাব কখনও কখনও আন্তর্জাতিক বাজারে নানান ধরনের ক্ষতির উপসর্গ তৈরি করছে।

দেশের ঔষধ শিল্পখাতের কলেবর কেবলই বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আমাদেরকে আরও বেশি আশাবাদী করছে। আসলে ঔষধ শিল্প কোন সাধারণ শিল্প নয়।

শুধুমাত্র পুঁজি থাকলেই এই শিল্প গড়া যায় না। ঔষধ শিল্প জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সমন্বয়ে উৎকর্ষতা নির্ভর একটি শিল্প। এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে মানবিক দায়িত্ববোধও সবচেয়ে বেশি থাকতে হয়।

ঔষধ শিল্পের সাথে জড়িত উদ্যোক্তারা মনে করেন ব্যবসা বান্ধব নীতি সহায়তা প্রদান করা হলে এই খাত বাংলাদেশের জন্য বিদেশ থেকে আরও বড় ধরনের সাফল্য বয়ে আনতে সক্ষম হবে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজন আরও নীতি সহায়তা।

Scroll to Top