দূরদেশে কাছের মানুষদের জন্য ভালোবাসা – আনন্দ আলো

দূরদেশে কাছের মানুষদের জন্য ভালোবাসা – আনন্দ আলো

এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি। ৩০ মিনিট পর পর মেইল আসছে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের। তারা মেইলে শুধু ফ্লাইট টাইম পিছিয়েই চলেছে। ফ্লাইট ডিলে হতে হতে ৮ ঘন্টা টোটাল ডীলে হলো। নিউজ ফিডে দেখছি — দুবাই এয়ারপোর্টের নাকাল অবস্থা। টিভিতে বন্যায় দূর্ভোগের চিত্র সারা বিশ্বমিডিয়ায়। সন্ধ্যারাতে হযরত শাহজালাল এয়ারপোর্টে স্ত্রী অণিমা আমাকে সী অফ করে গেছে। এখন বাজে রাত দেড়টা। আমি ঢাকাতেই বসে আছি। লাউঞ্জের বিভিন্ন অতিথি অন্যান্য এয়ারলাইন্সে করে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমি বসে বসে সময় গুনছি। এর ভেতরে মেসেঞ্জারে ফোন। উপস্থাপক—অভিনেতা কলিগ শাহরিয়ার নাজিম জয়। ‘তানভীর ভাই ভুলেও এমিরেটস এ উইঠেন না। দুবাই আসলেই কিন্তু ধরা খাবেন। আমি বাঁচি না মরি ঠিক নাই। এখানে ভয়াবহ অবস্থা। বলে বোঝাতে পারবে না। আমার স্ত্রী আমার সাথে। সে কান্নাকাটি শুরু করেছে। আমাদের জন্য দোয়া কইরেন।’
এটুকু বলেই ফোন কেটে দিলো জয়।

কী দ্বিধায় পড়লাম! জীবনে লোকাল বাসে ভীড় দেখলে উঠিনি। নৌকায় বেশি লোকজন দেখলে গ্রামে উঠতাম না। পরেরটার জন্য অপেক্ষা করতাম। জীবনে এত বড় এয়ারলাইন্সের টিকেট হাতে নিয়ে সেটাতে স্বেচ্ছায় উঠবো না। এমন তো কোনো অভিজ্ঞতা আমার মতো মধ্যবিত্ত জীবনে নেই। কী বিপদে পড়া গেল! আমি মনে মনে ভাবলাম —যা হবার হবে। জীবনে কোনো কিছুই আমার সহজে হয়নি। তাই এসবে অভ্যস্থ। এরকম একটা ভাবনা মনস্থির করে চুপচাপ বসে রইলাম ফ্লাইটের অপেক্ষায়। এদিকে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী আমাকে বার বার ফোন করে আপডেট জানতে চাইছেন। বলছেন,‘ তানভীর ভাই, আপনি গ্রীন সিগনাল দিলে বের হবো।’
আমি আর কী গ্রীন সিগনাল দিবো? নিজেই তো রেড সিগনালে পড়ে বসে আছি।


সম্পর্কিত

যাই হোক আবারও জয়। এবারে অডিও বার্তা। লাস্ট মেসেজ। সেখানে বললো— আমার ফোনের ব্যাটারি শেষ। আবারও বলছি ভুলেও এমিরেটস এ উইঠেন না। আর হয়ত কথা হবে না। বেঁচে থাকলে দেখা হতে পারে। দোয়া করবেন।’

এতো দেখি মহা বিপদে পড়া গেল! এদিকে এমিরেটস ওদের লাস্ট সিকিউরিটি চেক শেষে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সেখানে প্রায় ৪ ঘন্টা দাঁড়িয়ে যখন ফাইনাল বোর্ডিং নিতে যাবো, তখন তারা ঘোষণা করলো যে ফ্লাইট ক্যানসেল। আরও বললো, ‘আপনারা হোটেল রিজেন্সিতে আজ থাকবেন। আমরা ব্যবস্থা করছি। সবাই ইমিগ্রেশন শেষ করে যার যার লাগেজ নিয়ে টার্মিনাল ১ এ আমার আমাদের বাসের জন্য অপেক্ষা করুন। বাস আপনাদের হোটেলে নিয়ে যাবে।’
তখন ভোর সাড়ে ৫ টা!

মেজাজ সপ্তমে। ঘুমহীন ক্লান্তিতে শরীর শেষপ্রায়। হয়ত দীর্ঘদিন পর এয়ারপোর্টে কোনো ফ্লাইট তাদের বোর্ডিং নেবার সময় এভাবে ক্যানসেল করলো । তাই ইমিগ্রেশন অফিসাররাও দিগ্বিদিক! আমি আমার ড্রাইভারকে বললাম, একটু কষ্ট করে আবার এয়ারপোর্টে আসো। এমিরেটস এর দেয়া হোটেলে না থেকে সরাসরি বাসায় চলে এলাম। সন্ধ্যায় এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেয়া স্বামীকে সকালে স্ত্রী অণিমা ব্যাগ পেটরাসহ বাসায় দেখে তো হতবাক! পরদিন কুয়েত এয়ারওয়েজের টিকিট পাঠালো নিউইয়র্কের আশা হোম কেয়ারের আকাশ রহমান। তাঁর আমন্ত্রনেই যাওয়া। ফোনে বললেন,‘আপনার আর চঞ্চল ভাই একই ফ্লাইটে সম্ভবত। একসাথে চলে আসুন। হয়ত নিউইয়র্কে নেমেই সরাসরি আপনাদের অনুষ্ঠানে হাজির হতে হবে। রেস্ট পাবেন না।’
সেখানে সুচিত্রা সেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাবার কথা।

পরদিন আবারও বিমানবন্দরের একই লাউঞ্জে আমাকে দেখে লাউঞ্জের লোকজন অবাক! ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছে। ওরা ভাবতেই পারে। লাউঞ্জে ফ্রি খাবার জন্য ভুয়া এয়ার টিকিট ইমিগ্রেশন করে লোকটা প্রতিদিন আসছে!! এয়ারপোর্টে তো কতরকম বিচিত্র কান্ডই ঘটে! এদিকে চঞ্চল চৌধুরী লাউঞ্জে ঢুকলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক বর্তমানে আমলা মিথিলা ফারজানা ও তার পরিবারকে নিয়ে। মিথিলা আর চঞ্চল যে পরস্পরের আত্মীয় জানতাম না। সেদিন জানলাম।

মিথিলা ফারজানা যাচ্ছেন কানাডার অটোয়াতে। সেখানে বাংলাদেশ হাই কমিশনের প্রেস মিনিস্টারের দায়িত্ব নিতে তাঁর এই যাত্রা। তাঁকে অভিনন্দন জানালাম। বললাম। এবার নিউইয়র্কেও কাজ শেষ করে কদিনের জন্য টরন্টো যাবো। মিথিলা বললেন,‘তাহলে অটোয়াতে বোনের বাসায় চলে আসেন।’ মজা করে বললাম,‘ কেবলই জয়েন করছেন। গিয়ে একটু বাসভবনটা গুছিয়ে নেন। এখন থেকে অটোয়াতে তাহলে দুটো ডাল ভাত খাবার জায়গা হলো! মিথিলা বললেন,‘অবশ্যই। তা আবার বলতে হবে!’ আমি আর অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। একই ফ্লাইটে। কুয়েত এয়ারের লম্বা ফ্লাইট। কুয়েত যেতেই ৭ ঘন্টা আকাশে থাকতে হবে। আমাদের দুজনার গল্প ফুরায় না। গল্প দুজনার ব্যক্তিজীবন থেকে গোটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি অব্দি গড়ায়। চঞ্চল আর আমি কুয়েত এয়ারের পরিষেবা নিয়ে নানান মজা করতে থাকি। তবু সময় ফুরায় না।

১ ঘন্টার ট্রানজিট শেষে টানা ২৩ ঘন্টা জার্নি শেষ করে নিউইয়র্কের সকাল পৌনে ১০ টায় আমরা জেএফকে বিমানবন্দর থেকে বের হতেই দেখি আকাশ ভাই তার ড্রাইভারসহ গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ক্যালেন্ডারে ২০ এপ্রিল ২০২৪। নিউইয়র্কের আবহাওয়াটা চমৎকার। ঝিরিঝিরি ঠান্ডা হাওয়া। রোদের আলোটাও ঝকঝকে..
নিউইয়র্কের হায়াত হোটেলে পৌঁছে কোনোমতে ফ্রেশ হয়েই জ্যামাইকা সেন্টারে উৎসবের ভেন্যুতে চলে আসলাম আমি আর চঞ্চল চৌধুরী। অনুষ্ঠানের বাকি অতিথিরা আগেই ভেন্যুতে হাজির। যাবার আগে আমরা আশা হোম কেয়ারে চা বিরতি নিলাম।

অনুষ্ঠান শেষে সেখান থেকে আমেরিকা—কানাডার সবচেয়ে বড় বাংলা ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর কবিবন্ধু রাজ হামিদ বললেন,‘আজ রাতে ম্যানহাটনে আমার ডিনার ট্রিট। অনুষ্ঠান শেষ করে চলুন।’ রাজ হামিদ আমার ভীষণ প্রিয়জন। প্রতিবার আমেরিকা গেলেই তার শহর ক্যালিফোর্নিয়ায় তিনি নিয়ে যান আমাকে। এবার তিনিই নিউইয়র্কে। ভীষণ আড্ডা পাগল এক মানুষ। তার সাথে আমাদের আড্ডাটা চললো মাঝরাত অব্দি। নিউইয়র্কের বাংলা কমিউনিটিতে গেলে অন্যরকম এক আনন্দ হয়। ১১ বছর ধরে প্রায় প্রতি বছর দুয়েকবার করে এই প্রিয় শহরে আমার আসা হয়। যতবারই আসি বাঙালি কমিউনিটিদের আতিথেয়তা মুগ্ধ হতে হয়। বলা বাহুল্য, ঢাকার চেয়েও এখন সারাবছর নিউইয়র্কের বিভিন্ন ভেন্যুতে বাঙালিয়ানা অনুষ্ঠান বেশি হয়।

দুদিনের উৎসব অনুষ্ঠান পার করে আমার ল্যান্ড বর্ডার দিয়ে কানাডা যাবার প্ল্যান। টরন্টোতে ৩ দিনের শর্টট্রিপ। হোটেল থেকে একরকম জোর করে আকাশ ভাই নিয়ে গেলেন তার আশা ম্যানশন নামের বিশাল প্যালেসে। বললেন,‘তানভীর ভাই— আপনি আমার গেস্ট। হোটেলে থাকার দরকার কী। আমার ৯ টা বেড রুম ফাঁকা পড়ে থাকে। বাসায় আমরা মাত্র দুজন মানুষ। যেই রুমে ইচ্ছে থাকবেন।’ এই বলে আমাকে হোটেল থেকে নিয়ে গেলেন তার রাজপ্রাসাদে।

মানুষটি বেশ সদালাপী। পরিশ্রমী। সফল এক উদ্যোক্তা। পরে খেয়াল করলাম। আকাশ রহমান তার স্পন্সরকৃত অনুষ্ঠানের নায়ক নায়িকা যাকেই দেখছেন। তাকেই বলছেন আপনি আমার বাসায় উঠতে পারেন। আমার তো ৯ টা বেড বাসায় খালি পড়ে থাকে! বুঝলাম লোকটা ভীষণ মজার ও প্রাণখোলা। মজা করে বললাম,‘আপনার ৯ বেডের গল্প কিন্তু ২০ জনের বেশি মানুষকে বলে ফেলেছেন। সবাই যদি রাজী হয়! হাসতে হাসকে আকাশ জবাব দেন,‘তার নিউইয়র্কে আরো দুটি বাড়ি রয়েছে। একটা ব্যবস্থা হবেই।’ আকাশ রহমানের বাড়ি পাবনায়। আমার নানা বাড়ির এলাকায়। নিজের দীর্ঘ অধ্যাবসায় আর পরিশ্রমে প্রায় ৩০০০ বাঙালি এখন তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করছেন। বাংলাদেশেও তার দুটো প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। যাই হোক অনুষ্ঠান থেকে আকাশ ভাইয়ের বাড়িতে এক সাকসেস পার্টি কল করা হলো। সেখানে চঞ্চল চৌধুরী, মৌসুমী, কলকাতার ঋতুপর্ণা থেকে শুরু করে সকলের মিলন মেলা। চঞ্চল দুটো গান গেয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিলেন! নির্মাতা হৃদি হক, চঞ্চল সহ আমরা সেই অনুষ্ঠান শেষ করে গেলাম হৃদির পুরণো বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা দিতে। এশহরে যেন কখনওই রাত ঘুমাতে চায় না। পরদিন আমার সকালে যেতে হবে নিউইয়র্ক এর আমস্টারডাম শহরে। চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায় শাহীন কবির আমাকে নিয়ে যাবেন সেখানে তার বিশাল বাংলো বাড়ি দেখাতে।

আকাশ রহমান বা শাহীন কবির— তারা তাদের এইসব সাফল্যগুলো প্রিয় মানুষদের যখন দেখাতে চান। সত্যিই বাংলাদেশী হয়ে গর্বে বুকটা ভরে যায়! বাঙালি হয়ে এই খরুচে শহরে যখন এত বিরাট সাফল্য নিয়ে যাপন করেন। তখন আমাদেরও উচিৎ সেগুলোকে হাইলাইট করা। একই সাথে তারা প্রত্যেকেই বাংলাদেশ থেকে আসা তরুনদের কর্মসংস্থান তৈরির ব্যাপারে বিশাল ভুমিকা রাখছেন। শাহীন কবিরের গাড়িতে চেপে আমি তখন আমস্টারডাম শহরের পথে। মাত্র আড়াই ঘন্টার ড্রাইভ। উন্নত শহর। ঝাঁ চকচকে রাস্তা। চারপাশের গাছের পাতাগুলো সবুজ থেকে রঙিন হতে শুরু করেছে। তাই এই আড়াই ঘন্টায় ঢাকা টু কক্সবাজারেরও বেশি পথ চলে এলাম। না, নেদারল্যান্ডের আমস্টারডাম না। নিউইয়র্কের আমস্টারডাম। সেখানে বাংলাদেশী এক নাগরিক শাহীন কবির তার দীর্ঘ ৪৩ বছর ধরে নিউইয়র্কে কনস্ট্রাকশন ফার্ম চালাচ্ছেন। ৮ একরের আলিশান বাংলো বাড়ি কিনেছেন। মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখতে থাকলাম।
এখানে একরাত থেকে পরদিন সকালে অ্যামস্টারডাম স্টেশন থেকে অ্যামট্র্যাক ট্রেনে চেপে রওনা হবো কানাডার উদ্দেশ্যে।

ট্রেন চলছে। ছিমছাম ট্রেনের কামরা। লোকজন কম। একটা বিশাল কামরা বরাদ্দ শুধু খাবার জন্য। ১৩ ঘন্টার লম্বা জার্নি। কিন্তু বাইরের অপরূপ প্রকৃতি আপনাকে ঘুমোতে দেবে না। বিখ্যাত নায়াগ্রা জলপ্রপাত পার হবো এই ট্রেনে চেপে। নায়াগ্রা ফল’টিই মূলত আমেরিকা আর কানাডাকে দু’ভাগ করেছে। অনেকবার আমেরিকা সাইডের নায়াগ্রা জলপ্রপাতের পাড়ে গিয়েছি। প্রথমবারের মতোত যাচ্ছি ওপারে। কানাডা ভিসা নেয়া ছিল আমার আরো বছর তিনেক আগে। কিন্তু কোনোভাবে যাবার সুযোগ হয়নি। এবারে প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ আশিকুজ্জামান টুলু ভাইয়ের আমন্ত্রনে যাচ্ছি। সেখানে একটি রিয়েলিটি শোয়ের প্রথম বৈঠকে আমি, বরেণ্য কন্ঠশিল্পী তপন চৌধুরী, প্রখ্যাতত কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব তসলিম আহমেদ একসাথে আড্ডা দেব টুলু ভাইয়ের কানাডার বাড়িতে। সেই অপেক্ষায়। ট্রেন এগুচ্ছে। সলো ট্রাভেলার হলেও মুঠোফোনে যদি আপনার ওয়াইফাই এর সংযোগ থাকে তাহলে আপনি কখনওই বোর হবেন না। আমিও তাই। ট্রেন এ দারুণ ফ্রি ওয়াই ফাইএর সুব্যবস্থা। যদিও নেটওয়ার্ক ততটা নেই। তবুও সময় পার করা যায়।

ট্রেন থেকে চলমান নানান স্টেশনের দৃশ্য ছবিগুলো ধারণ করে চলেছি একের পর এক। সন্ধ্যারাতে এই ট্রেন আমাকে নতুন একটি দেশে নামিয়ে দেবে!

তানভীর তারেক

Scroll to Top