খাবারের তীব্র সংকটের ফলে একটি দেশের জনগোষ্ঠী গুরুতর অপুষ্টি, অনাহার বা মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়লে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সাধারণত কোনো দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে কিনা, সেটা ঘোষণা করে জাতিসংঘ।
কখনও কখনও দেশটির সরকারের সাথে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা বা মানবিক সংস্থাগুলোর সাথে মিলে এই ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। মূলত, সমন্বিত খাদ্য নিরাপত্তা পর্যায় বা আইপিসি নামের জাতিসংঘের একটি মাপকাঠির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিবিসি জানায়, তীব্রতার পাঁচটি ‘পর্যায়ের’ ভিত্তিতে একটি দেশের খাদ্য ঘাটতি বা খাবারের নিরাপত্তাহীনতার র্যাঙ্কিং করা হয়, যার পঞ্চম ও সর্বশেষ ধাপ দুর্ভিক্ষ। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করতে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় তিনটি জিনিস ঘটতে হবে:
কমপক্ষে ২০ শতাংশ পরিবার খাদ্যের চরম সংকটের মুখোমুখি হবে; কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগবে; ১০ হাজার মানুষের মধ্যে প্রতিদিন দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক বা চারটি শিশু ‘সম্পূর্ণ অনাহার বা অপুষ্টিতে ভুগে কিংবা রোগে আক্রান্ত হয়ে’ মারা যাবে।
গাজা ও সুদান দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে
জাতিসংঘের মতে, উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষ আসন্ন আর ২০২৪ সালের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে যেকোন সময় তা ঘটতে পারে। ইসরায়েলের ওপর হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার পর গাজায় কয়েক মাস ধরে চলা সংঘর্ষের ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
আইপিসির শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী, গাজার প্রায় ১১ লাখ মানুষ অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী ক্ষুধার্ত। পরিস্থিতি যদি সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছায় তাহলে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে গাজার সবাই দুর্ভিক্ষের মুখে পড়বে।
জাতিসংঘ বলেছে, আইপিসির নথিভুক্ত যেকোন অঞ্চল বা দেশের তুলনায় গাজায় বেশি সংখ্যক মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
এছাড়া, সুদানে চলমান সংঘাত দেশটিকে ‘সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে মানবিক দুর্দশায় নিমজ্জিত করছে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের কর্মকর্তারা, যা কিনা বিশ্বের বৃহত্তম ক্ষুধা সংকটের কারণ হতে পারে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের ফলে সুদানের প্রায় এক কোটি আট লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়েছে। আর ইউনিসেফ বলছে, ছোট শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির পাশাপাশি কলেরা, হাম এবং ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে।
কোন কোন দেশ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে
অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট হাঙ্গার নামের একটি মানবিক সংস্থার তথ্যমতে আরও কয়েকটি দেশেও ‘ক্ষুধার মাত্রা খুবই উদ্বেগজনক’ অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- আফগানিস্তান, কঙ্গো, ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চল, পাকিস্তান, সোমালিয়া, সিরিয়া এবং ইয়েমেন।
২০২৪ সালের মার্চে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ডব্লিউএফপি সতর্ক করেছিল যে অনবরত বাড়তে থাকা গ্যাং সহিংসতার কারণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুতর সংকটের সম্মুখীন হওয়া হাইতি ‘ধ্বংসাত্মক ক্ষুধা সংকটের দ্বারপ্রান্তে’ রয়েছে।
সেখানকার প্রায় ১৪ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, তারচেয়ে এক ধাপ নিচের স্তরে আছে আরও ৩০ লাখ মানুষ। আইপিসির মতে, হাইতির খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি ‘আশঙ্কাজনক’।
দুর্ভিক্ষের কারণ
আইপিসি বলছে, দুর্ভিক্ষ এবং চরম খাদ্য সংকটের একাধিক কারণ রয়েছে। মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক কারণে কিংবা দুটোর সংমিশ্রণে দুর্ভিক্ষ হতে পারে। অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট হাঙ্গার বলছে, ‘বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার মূল কারণ’ সংঘাত।
সুদানের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের জন্য অপর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন ও খাবারের উচ্চ মূল্যকে দায়ী করা হয়েছে।
গাজায় চলমান সংঘাতের কারণে জীবন রক্ষাকারী খাদ্য, জ্বালানি ও পানি ভূখণ্ডটিতে ঢুকতে না পারা’র বিষয়টিকে তুলে ধরেছে আইপিসি।
আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটির (আইআরসি) মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে চরম আবহাওয়া সৃষ্টি হয়েছে, তার কারণে সৃষ্ট খরা এবং ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খাদ্য ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে পূর্ব আফ্রিকায় এই ঘাটতি ব্যাপক।
আরও একটি কারণ এল নিনো। এটি মূলত জলবায়ুর একটি ধরন, যার কারণে প্রশান্ত মহাসাগরে ভূপৃষ্ঠের জলের উষ্ণতা অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে যায়। সংস্থাটির মতে, ইতোমধ্যেই এল নিনো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকায় খাদ্য সরবরাহের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এর আগে কোথায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়
সর্বশেষ ২০১৭ সালে দক্ষিণ সুদানে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। তিন বছরের গৃহযুদ্ধের পর প্রায় ৮০ হাজার মানুষ অনাহারে এবং আরও ১০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে ছিল।
সেই সময় কৃষির ওপর যুদ্ধের প্রভাবকে এর জন্য দায়ী করে জাতিসংঘ। সেসময় কৃষকরা গবাদি পশু হারিয়েছিল, ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমেছিল এবং মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল।
এর আগে – ২০১১ সালে দক্ষিণ সোমালিয়া, ২০০৮ সালে দক্ষিণ সুদান, ২০০০ সালে ইথিওপিয়ার সোমালি অঞ্চলের গোডে, ১৯৯৬ সালে উত্তর কোরিয়া, ১৯৯১-৯২ সালে সোমালিয়া এবং ১৯৮৪-৮৫ সালে ইথিওপিয়ায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল।
এছাড়াও ১৮৪৫ থেকে ১৮৫২ সালের একটি সময় পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডবাসী অনাহার ও রোগে ভুগেছেন। অভাবের তাড়নায় অনেকেই সেসময় দেশত্যাগ করেন, যা পরবর্তী সময়ে ‘মহা দুর্ভিক্ষ’ নামে পরিচিত পায়। সেসময় দেশটির এক তৃতীয়াংশ মানুষ আলু খেয়ে জীবন ধারণ করতেন।
কোনো এক অজ্ঞাত রোগের কারণে সেসময় দেশটিতে আলু উৎপাদনে ব্যাহত হওয়ায় তখন ১০ লাখ মানুষ মারা যায়। কিন্তু এর মধ্যেও সেই সময়ে দ্বীপটি শাসন করা গ্রেট ব্রিটেনে আলু আমদানি অব্যাহত ছিল।