তবু কেন ভাইরাল হওয়ার প্রবনতা – আনন্দ আলো

তবু কেন ভাইরাল হওয়ার প্রবনতা – আনন্দ আলো

রেজানুর রহমান

কী যে জামানা এসে গেল। কিছু একটা করতে গেলেই কম বেশী সবাই ভাইরাল হওয়ার কথা ভাবে। ভাবটা এমন, তোরা যে যা বলিস ভাই, যে কোনো মূল্যে আমার ভাইরাল হওয়া চাই। এ জন্য সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমকে বেছে নেয় সবাই। রাত দিন ২৪ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই বিচরণ। ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সকল শাখায় প্রতিক্ষণ, প্রতিমুহূর্তে একটা যেন রুচিহীন যোগ্যতা প্রকাশের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এমন ঘটনাও ঘটছে, একই পরিবারের স্বামী, স্ত্রী সন্তান এমন কী কাজের মেয়েও ইউটিউব চ্যানেলের মালিক। যে যেভাবে পারছে ইউটিউব চ্যানেলের জন্য কনটেন্ট বানাচ্ছে। সবার লক্ষ্য ভিউ বাড়ানো। যে কোনো মূল্যে ভাইরাল হওয়া। সে কারণে আপত্তিকর কনটেন্ট বিশেষ করে যৌণতার দিকেই সবার বিশেষ আগ্রহ। নারী-পুরুষের শারিরীক চাহিদা প্রসঙ্গ, নারীর খোলামেলা শরীর নিয়ে অশ্লীল কনটেন্ট প্রকাশের প্রতিযোগিতায় মত্ত অনেকে। শুধু শহরেই নয় গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ভাইরাল সংস্কৃতির দোর্দন্ড প্রতাপ শুরু হয়েছে। তরুণ-তরুণী এমনকী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও ভাইরাল কনটেন্ট বানানোর হিড়িক পড়েছে। পড়াশুনার প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ নাই। শুধু আগ্রহ কীভাবে একটি কনটেন্ট এর ভিউ বাড়ানো যায়। নিষিদ্ধ সবকিছুর প্রতিই মানুষের আগ্রহ বেশী। ইউটিউব, ফেসবুক সহ সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের সকল শাখায় তাই নিষিদ্ধ কনটেন্টকেই অনেকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে ফেসবুকে এখন আপত্তিকর ভিডিও এবং কনটেন্ট এর ছড়াছড়ি। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে ইন্টারনেট সংযোগ থাকা একটি মোবাইল ফোন সঙ্গে থাকলে আপনি দিনের পর দিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গ ছাড়াই সময় কাটিয়ে দিতে পারবেন। হচ্ছেও তাই। কী উচ্চবিত্ত, কী নিম্নবিত্ত এমনকী রাস্তার ভিখেরির হাতেও এখন ইন্টারনেট সংযুক্ত মোবাইল ফোন স্বাভাবিক ব্যাপার। ভিক্ষার অর্থ দিয়ে মোবাইল ফোনে এমবি ঢুকায় ভিক্ষুক। কারণ মোবাইল ফোনই এখন তার আনন্দ-বিনোদনের একমাত্র ঠিকানা।
ফেসবুক ওপেন করে ঘুরতে থাকুন দুনিয়ার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। যেন একটি বিচিত্রা অনুষ্ঠান দেখছেন। রাজনীতি, সমাজনীতি, কুটনীতি থেকে শুরু করে নাটক, সিনেমা, গানের পাশাপাশি যৌনতায় ভরা নানা কনটেন্ট এর মুখোমুখি হবেন। আপনার সামনে হাজির হবে জনপ্রিয় নারী তারকার যৌণ আবেদনময়ী নানা ধরনের স্থিরচিত্র। ভিডিও পাবেন। ফলে এমনও হচ্ছে খাবার টেবিলে বসেছে পরিবারের সকল সদস্য। এই সময় সাংসারিক নানা প্রসঙ্গ গুরুত্ব পাবার কথা। যেমন, ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা কেমন চলছে। কার কখন পরীক্ষা? পরিবারের মধ্যে কোনো সমস্যা আছে কী না ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক পরিবারের সব সদস্য এখন এক সঙ্গে খাবার টেবিলে বসেন না। বসলেও কেউ কারও সঙ্গে তেমন কথা বলেন না। কথা হয় মোবাইল ফোনটির সঙ্গে খাচ্ছেন ডান হাত দিয়ে। বাম হাতে চলছে ফেসবুক চর্চা। শ্লীল-অশ্লীল সবকিছুই বাবা-মায়ের সঙ্গে। পরিবারের ছোট্ট শিশুটিও দেখছে। আশঙ্কার বিষয় হল, আবদার মেটাতে অনেকে ছোট্ট শিশুর হাতেও এনড্রয়েট মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছেন। ফোনের সব অপশনই তার মুখস্থ। এটাই যেন বাবা-মায়ের অহংকার। আত্মীয় স্বজন কেউ বেড়াতে এলে অনেকে তাদের শিশু সন্তানের প্রতিভার গুণগাণ করতেই ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। জানেন আপা আমাদের নয়ন কিন্তু মোবাইল ফোনের দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে উঠেছে। এমন কিছু নাই যা সে পারে না। আমি বিপদে পড়লেই নয়নের হেল্প নেই…
ছোট্ট অবুঝ সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের এই যে অগাধ বিশ্বাস ও নির্ভরতা, এটা যে কতটা ভয়ংকর তা অনেকে বুঝেও না বুঝার ভান করেন। ফলে অনেক পরিবারে শিশু সন্তানও ক্ষতিকর ভাইরাল সংস্কৃতির শিকারে পরিণত হচ্ছে। যেহেতু সে মোবাইল ফোনের ইঞ্জিনিয়ার তাই অতি সহজেই ক্ষতিকর কনটেন্ট খুঁজে নেওয়ার ব্যাপারে সর্বদাই তৎপর থাকে। লুকিয়ে লুকিয়ে যৌণ দৃশ্য দেখে। কী যে একটা ভয়ংকর পরিস্থিতি…
বর্তমান সময়ে নাটক, সিনেমা এমন কী সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও ভিউটাই আসল। সবার উদ্দেশ্যই থাকে যে কোনো মূল্যে ভিউ বাড়ানো। তাই কনটেন্টের মধ্যে যৌণতা ভরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাই বেশী থাকে। একটি ভিডিও’র কনটেন্ট উল্লেখ করতে চাই। একটি ছেলে একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করছে, আগে মুখ দিয়ে চুষে তারপর ঢুকায়। এটার উত্তর কী? উত্তর দিতে গিয়ে মেয়েটি লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। প্রশ্নের উত্তর কিন্তু সোজা। সুই এর মধ্যে সুতা ঢুকাতে গেলে প্রথমে সুতা মুখে নিয়ে চুষতে হয়। তারপর সুইয়ের ছিদ্রে ঢুকাতে হয়। অথচ এই বিষয়টিকে যৌণতার আবরণে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভিউ বেশ। অবাক কান্ড।
এরকম অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারি। ভিউ বাড়ানোর কদর্য লড়াইয়ে মত্ত অনেকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ভিউ বাড়ানোর লড়াইয়ে ইদানিং আমাদের শোবিজের ব্যস্ত তারকারাও রীতিমতো লড়াইয়ে নেমেছেন। গান, অভিনয়ের ক্ষেত্রে অনেকের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। তবুও আধুনিক ফটোসেশনের নামে অনেকেই শরীর প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কোনো অনুষ্ঠান, বিশেষ করে অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে গেলে দেখা যায় নারী তারকাদের আধুনিক ফ্যাশন প্রতিযোগিতার বিতর্কিত প্রকাশ ভঙ্গি। কিছুদিন আগে চীনমৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে একটি অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে একজন দুর্দান্ত জনপ্রিয় নারী তারকা এলেন অত্যন্ত খোলামেলা পোশাক পড়ে। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল, ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলের প্রতিনিধি, ক্যামেরাম্যান তার ছবি তোলার জন্য রীতিমত লড়াই শুরু করে দিল। নারী তারকা গর্বের ভঙ্গিতে সবার দিকে তাকাচ্ছেন। মিটিমিটি চোখে হাসছেন। পাশে দাঁড়ানো এক ব্যক্তি বিরক্ত হয়ে বললেন, এরা আসলে চায় কী? শীতে মানুষ কাঁপছে। অথচ উনি এসেছেন কাপড় বিহীন শরীর নিয়ে। তার উদ্দেশ্য পরিস্কার। ভাইরাল হবার ইচ্ছে। ভাইরাল হলেই নিজের একাউন্টে অর্থ ঢুকবে।
জয়া আহসান। আমাদের নাটক, সিনেমার দুর্দান্ত জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তার অভিনয় দেখার জন্য দর্শক উম্মুখ হয়ে থাকে। জয়া আহসানের নাটক, সিনেমা মানেই দর্শকের বিপুল আগ্রহের বিষয়। এমন একজন জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী যখন ফটোসেশনের নামে যৌণতাকে প্রশ্রয় দেন তখনই যেন একটু খটকা লাগে। এমন মন্তব্য করলেন একজন দর্শক। তার মন্তব্য একজন বিশিষ্ট অভিনেত্রীকে কেন শরীর দেখানো ফটোসেশন করতে হবে? তাহলে কী আমরা ধরে নিব তিনিও ভিউ বাড়ানোর তথাকথিত অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন?
নাটক, সিনেমার আলোচিত মুখ সোহানা সাবা। দুর্দান্ত অভিনেত্রী। তিনিও মাঝে মাঝে আধুনিক সাজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরেন। যেখানে যৌণতাই গুরুত্ব পায় বেশী। তার মানে এই নয় যে যৌণতা জীবনের অংশ নয়। অবশ্যই জীবনের গুরুত্বপুর্ণ অংশ। তাই বলে যৌণতা তো এতো সহজ লভ্য হতে পারে না।
নাটক, সিনেমার ব্যাপক আলোচিত মুখ রুনা খান। তার অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ সব শ্রেণীর দর্শক। রুনা খান যখন যে চরিত্রে অভিনয় করেন সেটাকেই পারফেক্ট মনে হয়। অভিনয়ের ক্ষেত্রে তার আত্মনিবেদন সত্যি প্রশংসার যোগ্য। সেই রুনা খান যখন শরীর দেখানো ফটোসেশন করেন তখন প্রশ্ন ওঠে তার এই বয়সে এতটা কী দরকার ছিল?
নুসরাত ফারিয়া আমাদের সিনেমার অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী। ব্যস্ততম চিত্রনায়িকা। তার জীবন সংগ্রাম অন্যের জন্য প্রেরণার উৎস হতে পারে। সেই নুসরাত ফারিয়া যখন অনেকটা খোলামেলা পোশাকে সাধারনের মাঝে হাজির হন তখনই নানা প্রশ্নের উদয় হয়।
এরকম উদাহরণ আরও অনেক তারকার ক্ষেত্রে দেওয়া যায়। যাদের দুর্দান্ত তারকা খ্যাতি থাকা সত্বেও ভাইরাল সংস্কৃতির দিকেই ঝুকছেন।
ব্যাপারটা এমন নয় যে কে কেমন পোশাক পরবেন, কার কেমন পোশাক পরা উচিৎ কার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিৎ এই ব্যাপারে একটা সবক দেয়ার চেষ্টা করছি আমরা। এই দায়িত্ব মোটেই আমাদের নয়। সবারই ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। কারও ব্যক্তি স্বাধীনতায় আমরা হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তবে আমাদের একটি আরজি আছে। বাংলাদেশের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। পারিবারিক, সামাজিক ভাবে একটি রীতিনীতি আছে। সবার উচিৎ তা মেনে চলা। তার মানে এই নয় নারীকে ঘোমটা টেনে চলতে হবে। নারী অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে না। সেই দিন এখন আর নাই। মানুষ হিসেবে নারীকেও স্বাধীনতা দিতে হবে। কিন্তু নারী স্বাধীনতার নামে মন যা চাইলো তাই করলাম তা বোধকরি শোভন নয়। প্রায় প্রত্যেক ব্যস্ত তারকার ফেসবুক আইডি, ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেল আছে। তাদের ব্যক্তিগত ফটোগ্যালারিতে এমন সব ছবি আপলোড করা আছে যা অপ্রাপ্ত বয়স্কদের দেখা উচিৎ নয়। অথচ সবাই তা দেখছে। ফলে তারকার ভিউ বাড়ছে। ভিউ বাড়লেই তারকা ভাইরাল হচ্ছেন। ভাইলার হলেই নিজস্ব একাউন্টে অর্থ জমা হচ্ছে। শরীর দেখিয়ে বিনা পুজিতে অনেক অখ্যাত তারকাও ভাইরাল বানিজ্য করছেন। অভিনয়ের অ’ও হয়তো জানেন না। অথচ তিনি ভাইরাল তারকা। আবার যারা অভিনয় জানেন তারাও অনেকে অর্থের মোহে ভাইরাল হওয়ার দিকেই ঝুকে পড়ছেন।
আবারও বলি, কারও ব্যক্তিগত জীবন, ব্যক্তিগত ভাবনার ক্ষেত্রে আমরা মোটেই হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তবে যারা তারকা হয়ে উঠেছেন সমাজ ও দেশের প্রতি তাদের একটা দায়বদ্ধতা থাকা উচিৎ। তারকাদেরকে সাধারন মানুষ অনুসরণ করে, অনুকরণ করে। সে কথা ভেবেই তারকাদের উচিৎ ভাইরাল সংস্কৃতিতে যুক্ত হওয়া। একজন জনপ্রিয় তারকাকে সাধারন মানুষ অনুসরণ, অনুকরণ করে। কাজইে তার এমন কিছু করা উচিৎ নয় যার প্রভাব সমাজে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। শরীর নয় মেধাই হোক একজন শিল্পীর আসল যোগ্যতা।


সম্পর্কিত

Scroll to Top