ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বেশি পুরুষ, মৃত্যু বেশি নারীর

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বেশি পুরুষ, মৃত্যু বেশি নারীর


সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২৩:২৭

ঢাকা: দেশে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ২৬ হাজার। এর মধ্যে ১৩৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের হারই বেশি। তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের মধ্যে আবার নারীর হার বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণভাবেই দেশে নারীদের অসুস্থতাকে হালকা করে দেখার যে প্রবণতা রয়েছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত নারীদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রক্রিয়া শুরু করতে দেরি হওয়ার কারণে নারীদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেশি হতে পারে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত পুরুষ রোগীর সংখ্যা বেশি

এ বছরের আজ বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২৬ হাজার ৫৫৫ জন। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৬৭৭ জন পুরুষ। নারীর সংখ্যা ৯ হাজার ৮৭৮ জন। অর্থাৎ মোট ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৮০ শতাংশ পুরুষ, ৩৭ দশমিক ২০ শতাংশ নারী। সে হিসাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা ডেঙ্গু আক্রান্ত নারীর দেড় গুণেরও বেশি।

এদিকে যেসব পুরুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সীর সংখ্যা ৬ শতাংশের কিছু বেশি। ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী ছেলেদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার ৫ শতাংশের কম। পুরুষদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়া রোগী ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী পাওয়া গেছে সাড়ে ৬ শতাংশের কিছু বেশি, ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে এ হার ১৪ শতাংশের কিছু কম।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে। পুরুষদের মধ্যে এই বয়সীদের হার প্রায় অর্ধেক— ৪৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে হাসপাতালে ৪১ থেকে ৮০ বছর বয়সী পুরুষ ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে ২০ দশমিক ৬২ শতাংশ। ৮০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে এই হার ১ শতাংশেরও কম।

অন্যদিকে যে ৯ হাজার ৮৭৮ জন নারী ডেঙ্গুকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে, তাদের মধ্যেও বয়সভেদে আক্রান্ত হওয়ার অনুপাতও পুরুষদের মতোই। পাঁচ বছরের কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার প্রায় ৮ শতাংশ। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ছয় থেকে ১০ বছর ও ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সে এই হার সাড়ে ৬ শতাংশের আশপাশে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সীদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ। পুরুষদের মতো মেয়েদের ক্ষেত্রেও আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে— ৪৪ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া ৪১ থেকে ৮০ বছর বয়সী নারীর সংখ্যা প্রায় ২৩ শতাংশ। আর ৮০ বছরের বেশি বয়সী নারীর সংখ্যা ১ শতাংশের কম।

ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি নারীর

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা নারীর তুলনায় প্রায় পৌনে দুই গুণ হলেও মৃত্যু বেশি হয়েছে নারীদেরই। বুধবার পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতর যে ১৩৮ জনের ডেঙ্গুতে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে, তার মধ্যে ৭২ জন নারী, পুরুষ ৬৬ জন।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারীদের বয়স বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নবজাতক থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের কম বয়সী মেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তিনজন, ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী ছয়জন। ১১ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে এই সংখ্যা চারজন। আর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি নারী মৃত্যুবরণ করেছেন ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে— ২২ জন।

এ ছাড়া ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী সাতজন, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ১৩ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী চারজন, ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সী আটজন ও ৭১ থেকে ৮০ বছর বয়সী পাঁচজন নারী মারা গেছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। আশি বছরের বেশি বয়সী কোনো নারী এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাননি।

অন্যদিকে চলতি বছর এখন পর্যন্ত যে ৬৬ জন পুরুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তাদের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু চারটি। ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী পাঁচ শিশু এবং ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী কিশোর-তরুণের ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে আটজনের। ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী পুরুষের সংখ্যা ৯ জন।

এ ছাড়া ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণকারী পুরুষদের মধ্যে ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সীর সংখ্যা ১১ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী আটজন, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী সাতজন, ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সী পাঁচজন ও ৭১ থেকে ৮০ বছর বয়সী সাতজন। ৮০ বছরের বেশি বয়সী দুজন পুরুষ এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীর মৃত্যু বেশি?

ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা নারীদের তুলনায় পুরুষ অনেক বেশি হলেও মৃত্যু বেশি নারীদের মধ্যেই। এর পেছনে কারণ কী হতে পারে— জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল তিনটি বিষয়ের কথা তুলে ধরেন সারাবাংলার কাছে।

প্রথমত, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের জ্বরকে প্রথম দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাই নারীদের দ্রুত চিকিৎসার আওতায় নেওয়া সম্ভব হয় না।

দ্বিতীয়ত, অসুস্থতায় পুরুষদের হাসপাতালে ভর্তির বিষয়টি যতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়, নারীদের ক্ষেত্রে সেটি করা হয় না। ফলে নারীর অসুস্থতা গুরুতর না হলে তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয় না।

তৃতীয়ত, নারীর ওপর সংসারের কাজের বোঝা যেভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাতে নারী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে সেই কাজের দায়ভার নেওয়ার মতো কেউ থাকে না বলে অনেক সময় নারীকে অসুস্থ শরীর নিয়েও বাসাবাড়িতেই অবস্থান করতে হয়।

ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেক ক্ষেত্রেই নারী জ্বরে আক্রান্ত হলে সেটাকে অবহেলা করা হয়। তাদের জ্বরকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আবার অনেক পরিবার মনে করে, নারী অসুস্থ হয়ে বিশ্রাম নিলে সংসার চলবে কীভাবে। নারীদের মধ্যেও এমন ভাবনা কাজ করে থাকে। ফলে জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়াটা নারীদের ক্ষেত্রে শুরুর দিকে ঘটে না। এরপর তাদের এমন এক অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে নেওয়া হয় যখন নানা জটিলতায় তার অবস্থা গুরুতর হয়ে গেছে।

অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন ড. ফয়সাল। তিনি বলেন, অনেক সময় অন্তঃসত্ত্বা নারীর যত্নও গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া হয় না। জ্বর হলে সামান্য কিছু ভেবে অবহেলা করা হয়। অনেক সময় সেই অবহেলার কারণে নমুনা পরীক্ষাও করানো হয় দেরিতে। তখন রোগীর পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে।

বিশেষ করে ডেঙ্গু মৌসুমে জ্বর এলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে দ্রুততম সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন ড. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে জ্বর এলে সেটাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো উপায় নেই। পুরুষ হোক বা নারী, সবাইকে জ্বর আসার একটা নির্দিষ্ট সময় পরে অবশ্যই এনএস১ থেকে শুরু করে জরুরি শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করানো প্রয়োজন। কোনটা ডেঙ্গু জ্বর আর কোনটা স্বাভাবিক জ্বর, সেগুলো নিজে না ভেবে যথাসময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

অন্তঃসত্ত্বা নারী জ্বরে আক্রান্ত হলে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জ্বর এলে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। তাদের যেন মশার কামড় থেকে দূরে রাখা যায়, সেই আবহটাও ঘরে নিশ্চিত করতে হবে। মশারির ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি এডিস মশা যেন ঘরে কোনোভাবেই বংশ বিস্তার করতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর


ডেঙ্গু
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত
ডেঙ্গুতে মৃত্যু

Scroll to Top