টেকসই এবং পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্য ডিজাইন করে যাচ্ছেন স্থপতি এহসানুল করিম – আনন্দ আলো

টেকসই এবং পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্য ডিজাইন করে যাচ্ছেন স্থপতি এহসানুল করিম – আনন্দ আলো

মোঃ এহসানুল করিম। বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান স্থপতি। আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয়ে স্থাপত্যশিল্পে স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে টেকসই এবং পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্য ডিজাইন তৈরি করে যাচ্ছেন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। ১৯৯৯ সালে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিন থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। তাঁর রয়েছে ডিজাইন স্কেপ আর্কিটেক্টেন স্টুডিও নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট ও কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যে তিনি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার নকশা করেছেন। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি তে স্বনামধন্য এই স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

বাংলাদেশের আবহাওয়া, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ রেখে প্রতিটি প্রকল্পে নিখুত সৌন্দর্য, কার্যকারিতা, টেকসই এবং পরিবেশ বান্ধব নকশার সমন্বয় ঘটান এহসানুল করিম। তাঁর গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলায়। জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনায়। এহসানুলের বাবার নাম মোঃ আবুল বাশার। তিনি ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। মা মমতাজ বেগম গৃহিণী। দুই ভাই বোন এর মধ্যে দ্বিতীয়। খুলনা সেন্ট জোসেফ স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৯১ সালে। ১৯৯৩ সালে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে। ১৯৯৯ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এর পর পরই তিনি নিজেই গড়ে তোলেন ডিজাইন স্কেপ আর্কিটেক্টেন স্টুডিও নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান স্থপতি। ইতোমধ্যে এহসানুল করিম দেশের নামকরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিল্ডিং, কমার্শিয়াল বিল্ডিং, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, ইউনিভার্সিটি, মসজিদ সহ অসংখ্য ভবনের নকশা করেছেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের মিরসরাই এ ৩০ একর জমির ওপর প্রিমিটেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, কেন্দুয়া জামে মসজিদ, কুমিল্লায় আর্মিদের বাউস্ট ইউনিভার্সিটি (ইঅওটঝঞ), গাজীপুরের কাশিমপুরে এবং নরসিংদীতে মাসকো গ্রুপের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মানিকগঞ্জের কালামপুরে ওডেসী ক্রাফ্ট গ্রীন ফ্যাক্টরি এবং এ এন সি মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ফ্যাক্টরি, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কমপ্লেক্স, কনডোমিনিয়াম প্রজেক্ট নাভানা সিটিডেল (সিটি ইন দা সিটি), কুমিল্লা সেনানিবাসে আর্মি স্পোর্টস কমপ্লেক্স, রূপগঞ্জে প্রকল্পিত নেভাল অফিসারদের হাউজিং প্রজেক্ট প্রকল্প, সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন করেছেন। ১৯৯৮ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম নাজনীন ফেরদৌসী । এই দম্পতি দুই সন্তানের জনক জননী।
তরুন স্থপতিদের উদ্দেশ্য স্থপতি মোঃ এহসানুল করিম বলেন, নিরন্তর শেখার মানসিকতা: স্থাপত্য একটি সৃষ্টিশীল এবং সময়ের সহিত সর্বদাই পরিবর্তনশীল ক্ষেত্র। সেজন‍্য নতুন প্রযুক্তি, ডিজাইন ট্রেন্ড এবং নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন থাকাটা খুবই গুরুত্বপুর্ন।
অভিজ্ঞতা অর্জন: স্নাতকের পর একজন তরুন স্থপতির প্রধান কাজ হলো বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করা। সেজন‍্য তাকে পেশাদার স্থপতিদের সঙ্গে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখান থেকেই তিনি প্রকল্প পরিচালনা, বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যা সমাধান সহ সকল বাস্তবিক চাহিদা বোঝার জন্য কাজ করতে হবে।
নির্মাণের নীতি ও নিয়ম মেনে চলা: স্থানীয় বিধি, কনস্ট্রাকশন স্ট্যান্ডার্ড এবং টেকসই ডিজাইন প্রথাগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং এই অংশটুকু তিনি প্রধানত একজন পেশাদার স্থপতির সহিত কাজ করার মাধ্যমেই বেশী করে জানতে পারবেন।


সম্পর্কিত

স্থপতি এহসানুল করিম

যোগাযোগ দক্ষতা: কর্মক্ষেত্রে সর্বদাই দলীয় সকল সদস্যদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক এবং স্পষ্ট যোগাযোগ অপরিহার্য। নিজের ডিজাইন ভাবনা সঠিকভাবে অন্যদের কাছে উপস্থাপন করার ক্ষমতা তৈরীর ব্যাপারে মনোযোগ দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
ধৈর্য এবং অধ্যবসায়: অনেক সময় প্রকল্পের কাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় এবং নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়। স্থপতি হিসেবে তিনি যেন হতাশ না হয়ে বরং সৃজনশীলতার সঙ্গে সমস্যা সমাধান করতে পারেন, সেদিকে মনোনিবেশ করবেন। কাজের বৈশিষ্ট সম্পর্কে স্থপতি এহসানুল করিম বলেন, আমার স্থাপত্যদর্শন এবং কাজের বৈশিষ্ট্য সমুহ প্রধানত তিনটি। প্রথমত আমাদের নিজস্ব জলবায়ুকে প্রাধান্য দেয়া। সেজন‍্য আমি প্রকৃতির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ স্থাপনাগুলি তৈরি করতে আগ্রহী। আমি বিশ্বাস করি, একটি স্থাপত্য শুধু স্থায়ী এবং কার্যকরী হিসাবেই নয় সাথেল সাথে স্থানীয় জলবায়ুর উপযোগী হওয়া উচিত যাতে এটি মানুষের জীবনের মান উন্নত করে।
দ্বিতীয়ত, স্থানীয় স্থাপত্যের ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যগুলোকে আমি আমার ডিজাইনে অন্তর্ভুক্ত করি। স্থানীয় স্থাপত্যের উপকরণ, শৈলী এবং নির্মাণ কৌশলগুলো আমি আধুনিক প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে মিশিয়ে একটি সৃজনশীল ও কার্যকরী ডিজাইন তৈরি করি। আমি বিশ্বাস করি, ঐতিহ্যগত স্থাপত্যের মূল্যবান উপাদানগুলি আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব, যা স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখায়।
এবং তৃতীয়ত আমার কাজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য ডিজাইন তৈরি করা। আমি সবসময় এমন ভবন ডিজাইন করার চেষ্টা করি, যা কম শক্তি ব্যবহার করে এবং প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে। স্থানীয় উপকরণ, পুনঃব্যবহারযোগ্য এবং পরিবেশের উপর কম প্রভাব ফেলে এমন নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করতে আমি বিশেষভাবে মনোযোগী।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি জানান, একজন স্থপতি হলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি কল্পনা এবং কার্যকারিতার মধ্যে সেতুবন্ধন করেন। তাদের ভূমিকা শুধুমাত্র নকশার আঁকা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়; স্থপতি তিনি তার নকশার মাধ্যমে এমন একটি সৃজনশীল পরিবেশ তৈরি করেন যাহা ব্যাক্তি তথা সমাজকে অনুপ্রাণিত করে এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্যে কাজ করে। আমি ২৪ বছর স্থাপত্য পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যা কিছু শিখেছি এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা আমাকে আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। ভবিষ্যতে আমি আমার সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে এমন স্থাপত্য সৃষ্টি করতে চাই যা শুধু ডিজাইনের জন্য নয়, বরং মানুষের জীবনযাত্রা এবং পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
টেকসই স্থাপত‍্য, আমার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা হচ্ছে টেকসই স্থাপত্যের ক্ষেত্রে আরও গবেষণা ও কাজ করতে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত সংকট মোকাবিলায়, আমি এমন ভবন ডিজাইন করতে চাই যা পরিবেশের উপর কম চাপ ফেলবে এবং কম শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করবে। আমি পুনঃব্যবহারযোগ্য উপকরণ, সৌর শক্তি ব্যবহার, পানি সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার নিশ্চিত করার দিকে আরও মনোযোগী হতে চাই। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা, ভবিষ্যতে, আমি এমন প্রকল্পে কাজ করতে চাই যা শুধু সৌন্দর্য এবং কার্যকারিতার দিক থেকেই উপযুক্ত না হয়ে, আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত থাকবে। আমি আরও স্থানীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি এবং স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দিতে চাই, যাতে এটি স্প্রাসঙ্গিক এবং উপকারী হয়।
সৃজনশীল এবং বহুমুখী ডিজাইন নিয়ে কাজ করতে চাই, যেখানে বিভিন্ন প্রকার স্থাপত্য শৈলী, কাঠামো এবং কনসেপ্টের সমন্বয়ে নতুন এবং সৃজনশীল স্থাপত্য তৈরি করা।সমাজিক দায়বদ্ধতা, স্থাপত্য শুধু ডিজাইন নয়, এটি সমাজের উন্নতির একটি মাধ্যম। যেহেতু আমাদের এবং আমার কর্মের প্রধান ক্ষেত্র হলো এই রাজধানী ঢাকা । সুতরাং আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনায় আমি নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত এই ঢাকায় আরও স্কার্যকরী এবং উন্নত জীবনমানের স্থাপনা বা স্থাপত‍্য তৈরি করতে চাই, যা মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করবে। এক্ষেত্রে, আমার লক্ষ্য হবে সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করে এমন ভবন তৈরি করা যা মানুষের প্রয়োজনীয়তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে।
সর্বোপরি স্থাপত্য একটি সৃষ্টিশীল এবং ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তনশীল ক্ষেত্র। সুতরাং প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে তথ্যপ্রযুক্তি, অটোমেশন এবং ডিজিটাল ডিজাইন টুলসের উন্নতির মাধ্যমে, আমি ভবিষ্যতে ডিজাইন প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত এবং নির্ভুল করা।

Scroll to Top