জলবায়ু পরিবর্তন শুধু বৈশ্বিক উষ্ণতা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও সৃষ্টি করছে নীরব এক সংকট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রা ও ঋতু পরিবর্তনের কারণে অ্যালার্জির মতো সমস্যাগুলো এখন দীর্ঘস্থায়ী ও তীব্র আকার ধারণ করছে।
জিও নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাক দিয়ে অনবরত পানি পড়া, চোখ চুলকানো, শ্বাসকষ্ট—শুধু বিরক্তিকর উপসর্গই নয়, বরং এগুলো অনেকের জন্য দৈনন্দিন জীবনের বড় বাধা হয়ে উঠছে। বিশেষ করে খড়জ্বর বা হে ফিভারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) জানায়, পরিবর্তিত জলবায়ু এখনই পরাগ ও স্পোরের উৎপাদন এবং বিস্তারে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। বসন্তকাল আগে এলে গাছপালা দ্রুত ফুল ফোটায়, যার ফলে পরাগ ঋতু দীর্ঘায়িত হয়। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বায়ু দূষণ ও আগ্রাসী উদ্ভিদ প্রজাতির বিস্তার, যা মানবদেহের অ্যালার্জেনের প্রতি সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ডব্লিউএমও এর তথ্য বলছে, ইউরোপে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় এক চতুর্থাংশ এখন বায়ুবাহিত অ্যালার্জিতে ভুগছেন। শিশুদের মধ্যে এই হার আরও বেশি—৩০% থেকে ৪০% পর্যন্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা করছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ইউরোপের অর্ধেক জনগোষ্ঠী অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হতে পারে। ফরাসি অ্যালার্জিস্ট ইউনিয়নের সভাপতি সেভেরিন ফার্নান্দেজ বলছেন, আমরা এখন এক অ্যালার্জি বিস্ফোরণের মুখোমুখি।
বায়ুজীববিজ্ঞানী নিকোলাস ভিসেজ জানাচ্ছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনে উদ্ভিদের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন—উষ্ণ ও শুষ্ক গ্রীষ্মে বার্চ গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও র্যাগউইড নামের আক্রমণাত্মক অ্যালার্জেনিক উদ্ভিদের বিস্তার ঘটে। এই উদ্ভিদটি এতটাই শক্তিশালী যে, একে ঘিরে ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ২০৪১-২০৬০ সালের মধ্যে ইউরোপে র্যাগউইড অ্যালার্জিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৭৭ মিলিয়নে পৌঁছাতে পারে।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইউরোপজুড়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে নানা উদ্যোগ। সুইজারল্যান্ডের ‘মেটিওসুইস’ ও ‘অটোপলেন’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের পরাগ ও স্পোর মানচিত্র তৈরি করে ব্যক্তিগত অ্যালার্জির সঙ্গে মেলানো হচ্ছে। ফ্রান্সের কিছু অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে ‘পলিনারিয়াম’—অ্যালার্জেন উদ্ভিদের একটি গবেষণাবাগান, যা সময়মতো অ্যালার্জির পূর্বাভাস দিয়ে দেয়।
প্যারিসের একটি উদাহরণে দেখা গেছে, হ্যাজেলনাট গাছ ডিসেম্বরেই ফুল ফোটাতে শুরু করেছে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। এর কারণ হালকা শীতকাল। ফলে ফুল আগে ফোটে, পরাগ বেশি ছড়ায়, আর অ্যালার্জির তীব্রতা বাড়ে। জাপানেও নেয়া হয়েছে সাহসী পদক্ষেপ। ২০২৩ সালে সেখানকার সরকার দেবদারু গাছ কেটে ফেলার উদ্যোগ নেয়, কারণ এই গাছগুলো ব্যাপক হারে পরাগ ছড়ায়। এখন সেগুলোর বদলে রোপণ করা হচ্ছে কম অ্যালার্জেন উৎপাদনকারী প্রজাতি।
প্যারিসের কাছে বসবাসকারী স্থপতি সাইমন বার্থেলেমি জানালেন, ক্লায়েন্টের বাগানে বার্চ গাছ থাকার কারণে প্রতি বছর অ্যালার্জির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয় তার। তিনি বলেন, আমি অ্যান্টিহিস্টামিন না খেলে চোখ চুলকায়, কাশি হয়, ঘুম ভাঙে বারবার।
ইউরোপেও স্থানীয় ও নতুন আগ্রাসী প্রজাতিগুলোর প্রতি বাড়ছে নজর। এখন অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে ম্যাপেল ও ফলের গাছের মতো কম ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতিকে। উদ্ভিদবিদ সালোমে পাসকেট বলছেন, লক্ষ্য শুধু অ্যালার্জেনিক প্রজাতি বাদ দেওয়া নয়, বরং বৈচিত্র্য নিশ্চিত করাও জরুরি।