নয়াদিল্লি, ১২ ডিসেম্বর – ভারতের সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছিল, তা অসাংবিধানিক নয় বলে গতকাল রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। অনুচ্ছেদটি অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর কিছু বিশেষ সুবিধা ভোগ করত। ২০১৯ সালে তা বাতিল করে এ বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। সাবেক রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত দুই অঞ্চল—জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখে ভাগ করা হয়।
কেন্দ্রের এ পদক্ষেপের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে ২৩টি মামলা হয়। সেগুলোকে একত্র করে শীর্ষ আদালতে শুনানি শুরু হয় গত ২ জুলাই। পরে এ বিষয়ে রায় ঘোষণার কথা থাকলেও ৫ সেপ্টেম্বর তা স্থগিত করেন আদালত।
প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ গতকাল এ রায় দেন। ওই বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি সঞ্জয় কিসান কল, বিচারপতি সঞ্জীব খান্না, বিচারপতি বিআর গাভাই ও বিচারপতি সূর্য কান্ত।
শীর্ষ আদালত জানান, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল অসাংবিধানিক নয়। সরকারের সিদ্ধান্তে ভুল ছিল না। একই সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদাও ফেরানোর নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। যত দ্রুত সম্ভব সেটিকে আবার রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বলা হয়েছে।
রায়ে বিচারপতিরা বলেন, ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচন করতে হবে। তবে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা পেলেও লাদাখ থাকছে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসেবেই।
পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ হলেও তিন ভাগে ৩৭০ অনুচ্ছেদের মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। প্রথমে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় রায় পড়ে শোনান। বিচারপতি গাভাই ও বিচারপতি সূর্য কান্তর রায় প্রধান বিচারপতির রায়ের সঙ্গে একত্রে পড়ে শোনানো হয়। আলাদা করে রায় পড়েন বিচারপতি কল ও বিচারপতি খান্না।
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় প্রথমে জানান, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক বলে মনে করেন না সুপ্রিম কোর্ট। তারা সর্বসম্মত একটি রায় ঘোষণা করবেন।
তিনি আরো বলেন, অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর মাধ্যমে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা আসলে একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। নিতান্তই সাময়িকভাবে তা প্রয়োগ করা হয়েছিল।
আদালত জানান, ভারতের সঙ্গে যেদিন থেকে জম্মু ও কাশ্মীর যুক্ত হয়েছে, সেদিন থেকে ওই রাজ্যের আলাদা করে কোনো অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব নেই। তা ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
২০১৮ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা ভেঙে দেয়া হয়েছিল। তারপর সেখানে জারি করা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসন। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মীরসংক্রান্ত নির্দেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি।
এর মাধ্যমে সংবিধানে ৩৬৭(৪) নম্বর অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়। ফলে সংবিধানের ৩৭০(৩) নম্বর ধারায় ‘রাজ্যের সংবিধান সভা’র বদলে ‘রাজ্যের বিধানসভা’ শব্দটি যোগ হয়েছিল। সেদিনই সংসদে বিশেষ মর্যাদা লোপ এবং জম্মু ও কাশ্মীর ভাগের বিল পাস হয়। পরদিন রাষ্ট্রপতি জানান, ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ আর কার্যকর হচ্ছে না।
গতকাল আদালত জানান, রাষ্ট্রপতির এ সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বৈধ। জম্মু ও কাশ্মীরের গণপরিষদ বাতিল হয়ে যাওয়ার পরও রাষ্ট্রপতি এটি করতে পারেন।
কেন প্রয়োগ করা হয়েছিল অনুচ্ছেদ ৩৭০? সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কল জানান, অনুচ্ছেদ ৩৭০ জম্মু ও কাশ্মীরে আনা হয়েছিল রাজ্যটিকে ভারতের বাকি রাজ্যগুলোর সঙ্গে সমান করে তোলার জন্য।
কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারের সন্তান বিচারপতি সঞ্জয় কিসান কল তার পৃথক রায়ে বলেন, ‘শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা সেনার কাজ। রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা তাদের কাজ নয়। কাশ্মীরের অন্দরে সেনা প্রবেশ করায় তার কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের।’
বিচারপতি সঞ্জীব খান্না তার রায়ে বলেন, ‘কাশ্মীরে অনুচ্ছেদ ৩৭০ সামঞ্জস্যহীন ফেডারালিজমের উদাহরণ ছিল। তা কখনো জম্মু ও কাশ্মীরের সার্বভৌমত্বের নির্দেশক নয়। তাই ওই অনুচ্ছেদ বাতিল কাশ্মীরের ফেডারালিজম অক্ষুণ্ন রেখেছে।’
সুপ্রিম কোর্টের এ রায়কে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এ রায় আশার আলো, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি এবং এক শক্তিশালী ও আরো ঐক্যবদ্ধ ভারত গঠনের ঘোষণাপত্র।’
তবে এ রায়ে হতাশ জম্মু ও কাশ্মীরের প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা। এনসি নেতা ওমর আবদুল্লাহ সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার পর জানান, তিনি হতাশ। ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ আজাদ পার্টির চেয়ারম্যান তথা প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ এ রায়কে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলেছেন।
জম্মু ও কাশ্মীরের দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ও মেহবুবা মুফতি এ রায়কে ‘হতাশজনক’ আখ্যা দিয়েছেন। এক্সে (টুইটার) ওমর আবদুল্লাহ বলেন, ‘হতাশ কিন্তু হতোদ্যম নই। সংগ্রাম চলবে। আজকের এই দিনে পৌঁছতে বিজেপির বহু বছর লেগেছে। আমরাও দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।’
মেহবুবা মুফতিও এক্সে এক ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘জম্মু–ও কাশ্মীরের জনগণ আশা ছাড়ছে না। লড়াইও ছেড়ে দিচ্ছে না। আমাদের সম্মান ও মর্যাদার সংগ্রাম চলবে। আমাদের পথচলার ইতি এখানে নয়। ভারত বলতে যা কিছু বোঝায়, এতে তারই ক্ষতি হলো। যে হাত তোমরা ধরেছিলে, তা আহত ও রক্তাক্ত।’
সূত্র: বণিক বার্তা
আইএ/ ১২ ডিসেম্বর ২০২৩