ঢাকা: রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হঠাৎ করে বেড়েছে জ্বর ও শরীর ব্যথায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ঘরে ঘরে একরকম মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে অজানা এই ভাইরাল জ্বর। এটিকে সাধারণ জ্বর মনে হলেও এর সঙ্গী হচ্ছে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, চোখ ও হাত-পায়ের জয়েন্টে ব্যথা, দুর্বলতা ও খাবারে অরুচিও। এখন পর্যন্ত এ জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো কারণ শনাক্ত করা যায়নি। ফলে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে।
বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ জ্বর, মাথাব্যথা, গলা ব্যথা, পেশি ও জয়েন্টে ব্যথা নিয়ে হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের চেম্বারে যাচ্ছেন। অনেকে আবার দুর্বলতা ও ক্ষুধামন্দার অভিযোগ করছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই উপসর্গগুলো ডেঙ্গু, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফয়েড কিংবা করোনার মতো হলেও রক্ত পরীক্ষায় সেসবের উপস্থিতি মিলছে না। এতে রোগীদের মাঝে উৎকণ্ঠার পাশাপাশি দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরাও।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন শিউলী আক্তার। তিনি বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘পাঁচদিন ধরে জ্বরে ভুগছি। সেইসঙ্গে শরীর ব্যথায় কিছুই করতে পারছি না। কিছু পরীক্ষা করানো হয়েছিল, তাতে কোনো কারণ পাওয়া যায়নি। ডাক্তার বলছেন ভাইরাল ফ্লু। কিন্তু ঠিক কী ভাইরাস তা বলতে পারছেন না।’
শেরে বাংলা নগরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে সাত বছর বয়সী সামিয়াকে নিয়ে এসেছেন তার মা নওরীন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘তিন দিন ধরে সামিয়ার জ্বর। ফার্মেসি থেকে জ্বরের ওষুধ নিয়ে খাইয়েছি। কিন্তু জ্বর ১০৩ ডিগ্রির নিচে নামছেই না। তাই হাসপাতালে নিয়ে এলাম।’ সামিয়ার মতো প্রতিদিন অনেক শিশু জ্বর নিয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসছে।
রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। ছবি: সারাবাংলা
পাঁচদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন রাজারবাগের বাসিন্দা পায়েল আক্তার। এজন্য রাজধানীর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন তিনি। সারাবাংলাকে পায়েল জানান, জ্বরের সঙ্গে কাশি ও শরীর ব্যথাও রয়েছে; সেইসঙ্গে রয়েছে দুর্বলতা। চিকিৎসক কয়েকটি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু রিপোর্টে জটিল কিছু আসেনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন আউটডোরে ১২০০ থেকে ১৪০০ রোগী হাসপাতালে আসে। এর মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ জ্বরের রোগী। জ্বরের সঙ্গে কিছু ডেঙ্গু পেলেও অজানা জ্বরের সংখ্যাটাই অনেক বেশি। এর সঙ্গে শরীর ব্যথা, বমিও আছে।’
তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ল্যাব রিপোর্টে কোনো সুনির্দিষ্ট রোগ পাওয়া যাচ্ছে না। সাবসিডার ইনজেকশন যেটা দরকার, সেটা আমরা দিতে পারি না। তাই রিপোর্টে যদি দেখি আদার্স নরমাল তখন আমরা রিপোর্টে লিখি ভাইরাস জ্বর। কিন্তু ঠিক কোন ভাইরাস তা নিশ্চিত নই।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা রোগীদের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, জ্বর হলে বাড়িতে বিশ্রাম নিন। প্রচুর পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করুন। নিজে থেকে অ্যান্টিবায়োটিক না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলুন। জ্বর তিন দিনের বেশি স্থায়ী হলে নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্রে যোগাযোগ করুন। আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তন, বাতাসে ধুলাবালি ও ভাইরাসের সক্রিয়তা বাড়ার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তবে আতঙ্ক না ছড়িয়ে সতর্কতা অবলম্বন করাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।

রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। ছবি: সারাবাংলা
এ বিষয়ে রাজধানীর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, চিকনগুনিয়া আর্টিফিশিয়ালভাবে রিপোর্টে ধরা পড়ছে। জ্বর বা কাশি হলে বিলম্ব করা যাবে না। কারণ, তার ডেঙ্গু নাকি চিকনগুনিয়া, নাকি সিজনাল ফ্লু, নাকি ভাইরাসজনিত সেটিতো সে বুঝতে পারবে না। এ বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেই হবে।’
সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘জ্বর হলে অবশ্যই বেশি করে পানি পান, তরল খাবার, ওরস্যালাইন, ফলের রস বা ডাবের পানি- এগুলো খেতে হবে। এর পর জ্বর, কাশি বা ব্যথা দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। অনেকের দেখা গেছে ডেঙ্গু হয়ে পড়ে আছে, কিন্তু সে বুঝতে পারছে না। পরে সিবিসি কাউন্ট করলে দেখা যায় ফিগারটা ডেঙ্গুর মতো। সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। নিজের মতো করে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না। বাইরে ধূলাবালি, বৃষ্টি, গরম-ঠান্ডা সবকিছু মিলিয়ে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এই সমস্যাগুলো হচ্ছে।’
এ অবস্থায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, পরিস্থিতি নজরদারিতে রয়েছে। এটি মৌসুমি ভাইরাস হতে পারে, যা আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে ছড়িয়ে পড়ছে।
জ্বর ও শরীর ব্যথা একটি উপসর্গ, যা কোনো রোগের কারণে হতে পারে। জ্বর ও শরীর ব্যথার কিছু কারণ হলো- সাধারণ ঠান্ডা, ফ্লু, বা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো রোগগুলোর কারণে জ্বর ও শরীর ব্যথা হতে পারে। আর্থরাইটিস, রিউমেটিক ফিভার, বা অন্য কোনো প্রদাহজনক রোগেও জ্বর ও শরীর ব্যথা হতে পারে। সংক্রমণ বা অসুস্থতার বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সক্রিয় হলে জ্বর এবং শরীর ব্যথা হতে পারে, যা সাইটোকাইন নামক রাসায়নিকের নিঃসরণের কারণে হয়।