দেশপ্রেম, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে স্থাপত্যশিল্পে এ দেশের জন্য সৃষ্টিশীল কাজ করে চলেছেন স্থপতি মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বাপ্পী। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জে এ আর্কিটেক্টস লিমিটেডে পার্টনার আর্কিটেক্ট হিসেবে আছেন। বর্তমানে তিনি ‘গ্রাউন্ড ওয়ান’ নামের প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্বনামধন্য এই আর্কিটেক্ট বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন তৈরি করেছেন। এবার শাহ্ সিমেন্ট ‘নির্মাণে আমি’তে এই স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন- মোহাম্মদ তারেক
পাশ্চাত্য স্থাপত্য তথা আধুনিক স্থাপত্যের অনুকরণ নয়, লোকজ উপাদান, জলবায়ু ও মাটির বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দিয়ে স্থাপনা সৃষ্টিই আমার স্থাপত্য ভাবনার মূল উপজীব্য। কথা গুলো বললেন স্থপতি মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বাপ্পী। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার গ্রীন রোডে। বাপ্পীর বাবা মোহাম্মদ শাহজাহান ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। মা হামীম জাহান গৃহিনী। তিন ভাইবোনের মধ্যে স্থপতি শাহনেওয়াজ বাপ্পী সবার বড়। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সংষ্কৃতির বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ছবি আঁকাআঁকি ছিল তার পছন্দের বিষয়। সেই ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন। অসাধারণ বাঁশি বাজাতে পারেন। কাজের ব্যস্ততার মাঝেও বাঁশির সুরে হারিয়ে যান কোনো এক গন্তব্যে। সৃষ্টিশীল কোনো কিছু করার উদ্দেশ্যে আর্কিটেক্ট হওয়া তার। সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৯৩ সালে। ১৯৯৫ সালে নটরডেম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। ২০০৫ সালে তিনি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করার কিছুদিন পর শাহনেওয়াজ বাপ্পী যোগ দেন খ্যাতিমান স্থপতি জালাল আহমেদের জে এ আর্কিটেক্টস-এ। সেখানে তিনি সিনিয়র আর্কিটেক্ট হিসেবে চার বছর করেন। ২০০৯ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘গ্রাউন্ড ওয়ান’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জে এ আর্কিটেক্টস লিমিটেড এ পার্টনার আর্কিটেক্ট হিসেবে আছেন। ইতোমধ্যে তিনি দেশের নামকরা ফ্যাক্টরি বিল্ডিং, হসপিটাল, অফিস বিল্ডিং সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন করেছেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে সিলেটের কুলাউরায় রুথনা রেসিডেন্স বিল্ডিং, সিলেট ইপিজেড এ ডিবিএল এর শ্রীহট্ট, সাভারে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির আইবিএ ডিপার্টমেন্ট, গাজীপুরে ইকো এফ এ বি অ্যাপারেল ফ্যাক্টরি, গাজীপুরে ইভিটেক্স অ্যাপারেল ফ্যাক্টরি, আশুলিয়ায় ফোর এ ইয়ার্ন অ্যাপারেল ফ্যাক্টরি, পাবনায় স্কয়ার ফুড এন্ড বেভারেজ ফ্যাক্টরি, ময়মনিসংহে ফরটিয়াস হসপিটাল, গাজীপুরে সূর্বনদীঘি রেসিডেন্স বিল্ডিং, বসুন্ধরায় ডেভিড রেসিডেন্স বিল্ডিং, নেভী ক্যাফেটেরিয়া ঢাকা, কুমিল্লায় খোদেজা ভিলা রেসিডেন্স বিল্ডিং সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন করেছেন। এছাড়াও বর্তমানে বেশ কয়েকটি নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন তিনি।
এছাড়াও বেশ কয়েকটি নতুন প্রজেক্টের কাজ চলছে তার। দেশীয় ম্যাটেরিয়ালস, এদেশের জলবায়ু, সংস্কৃতি নিয়েই কাজ করতে ভালোবাসেন শাহনেওয়াজ বাপ্পী। এ জন্য কাজের কোয়ালিটির ব্যাপারে তিনি কোনোরূপ আপস করতে চান না। ফলে তার কাজের ক্ষেত্রে মাশুলও কম দিতে হয়নি। তবে এ নিয়ে তিনি মোটেও চিন্তিত নন। বরং ভালো মানের কাজকেই শাহনেওয়াজ বাপ্পী প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। এই স্থপতির সব কিছু জুড়ে আছে নিজ দেশের প্রতি মমত্ববোধ আর অপার ভালোবাসা। দেশীয় ভাবনাকে পাশ্চাত্যের সাথে মিলিয়ে তার স্থাপত্য কর্মে নিয়ে এসেছেন ভিন্নরকম একটা আমেজ।
সম্পর্কিত
স্থাপনার কাজে শাহনেওয়াজ বাপ্পীর রয়েছে অসম্ভব সাফল্য। প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশ নিয়ে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে তার সাফল্যের ঝুঁড়িতে জমা হয়েছে সেরা কর্মের স্বীকৃতি। উল্লেখযোগ্য অ্যাওয়ার্ড গুলোর মধ্যে রয়েছে আইএবি আয়োজিত বার্জার এক্সিলেন্স বেস্ট ইয়ং আর্কিটেক্ট অ্যাওয়ার্ড, আইএবি আয়োজিত বার্জার এক্সিলেন্স কমেন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড, ইন্টারন্যাশনাল প্রপার্টি অ্যাওয়ার্ড আর্কিটেকচার ক্যাটাগরিতে সিঙ্গেল রেসিডেন্স সূবর্নদীঘি এর জন্য পুরস্কার, ভিয়েনার দ্বিবািির্ষক জরিপে ব্যাক স্টেজ আর্কিটেকচারে রুথনা রেসিডেন্স এর জন্য পুরস্কার, আইএবি এবং বিল্ড বাংলাদেশ লিমিটেডের স্বল্প আয়ের সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার বিজয়ী ইত্যাদি। স্থপতি শাহনেওয়াজ বাপ্পীর স্ত্রীর নাম চাঁদ সুলতানা। তিনি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেছেন।
তরুণ স্থপতিদের উদ্দেশ্যে স্থপতি মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বাপ্পী বলেন, তরুণ স্থপতিদের জন্য খুব জরুরী যে ক্লায়েন্টের সঙ্গে সঠিক যোগাযোগ স্থাপন করা, তখনই স্থাপনাটি প্রাসঙ্গিক গড়ে তোলা সম্ভব। আমরা হয়তো প্রায় সময়্ই ক্লায়েন্টকে আমাদের ভাষায় বোঝাতে সক্ষম হয়না কিন্তু সময় দিয়ে তাদেরকে ধর্য সহকারে বোঝালে অবশ্যই তারা খুব সহযোগী হয়ে ওঠেন। স্থাপত্যের সৃষ্টিতে আরো বেশি পশ্চিমা প্রভাব কাটিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করা উচিত।
একটি স্থাপত্য সৃষ্টি তখনই শিল্পমান সম্পন্ন হবে যখন তা পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ এবং মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে। আমাদেরকে আরো অনেক ধৈর্যশীল হতে হবে। আসলে সৃষ্টিশীল কাজ নির্ভর করে আমদের চিন্তা ভাবনায় স্বচ্ছতার উপর। এটা বেশ আনন্দের যে আমরা চিন্তা করতে সক্ষম। আবার একই সাথে এর অতিরিক্ত বাহুল্যতা আমাদের নিজেদের সৃষ্টিকেই নিরর্থক করে তুলতে পারে। মনে রাখতে হবে কোথায় থামতে হবে, মাত্রার সঠিক প্রয়োগই পারে আমাদেরকে সঠিক স্থাপনার দিকে ধাবিত করতে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ডিজাইনের দিকে নজর দেন স্থপতি মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বাপ্পী। এই স্থপতি তার নিজের কাজ সততা ও নিষ্ঠার সাথে করতে ভালোবাসেন। নিজের পেশার কাজে দায়বদ্ধ থেকে সেটাকে সততার সাথে শেষ করতে চান। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি শাহনেওয়াজ বাপ্পী বলেন, প্রতিনিয়ত কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে পারলে খুশি হব। আরো বেশি সৃষ্টিশীল অর্থপূর্ণ প্রাসঙ্গিক এবং মানবিক কাজ করে যেতে আগ্রহী।