ফাহিম মাশরুর
আড্ডার আমন্ত্রণ পাওয়া অনেকটা আকস্মিকভাবেই। সারাবাংলার প্রধান বার্তা সম্পাদক রহমান মুস্তাফিজ ভাই অফিসে জানালেন, ‘কানাডা থেকে টিটো ভাই আসছেন। প্রেস ক্লাবে জম্পেশ এক আড্ডা হবে, যাবেন নাকি?’ এমন প্রস্তাবে না বলাটা বোকামি হবে, সে তো বলাই বাহুল্য। দুদিনের অপেক্ষার পর অবশেষে দেখা ফরহাদ টিটোর সাথে। ৩১ জানুয়ারি, বুধবার পুরো সন্ধ্যা কাটল তার সাথে। সাথে ছিলেন মুস্তাফিজ ভাই, আজমল হক হেলাল ভাই, সুকান্ত গুপ্ত অলোক দাদা, শামিম হোসেন শিশির ভাইসহ অনেকেই। প্রায় তিন ঘণ্টার আড্ডায় টিটো ভাই খুলে বসলেন স্মৃতির ঝাঁপি। জমজমাট সেই আড্ডায় উঠে এলো ক্রীড়া সাংবাদিকতার সেকাল-একাল।
ফরহাদ টিটো। বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতার ‘পথিকৃৎ’ বললে হয়তো একটু কমই বলা হবে। যার হাত ধরে বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতা পেয়েছে নতুন এক মাত্রা, সেই টিটো ভাই অনেক বছর ধরেই আছেন দেশের বাইরে। দেশের সাংবাদিকতা থেকে দূরে থাকলেও তিনি মনে-প্রাণে এখনো সেই ‘খেলার মানুষই’ আছেন। সেই ৯০ এর দশকে বাংলাদেশে পত্রিকাগুলোতে যখন ছোট্ট এক কোনায় জায়গা পেত খেলার খবর, তখনই ক্রীড়া বিভাগের মহীরুহ হয়ে আবির্ভাব টিটো ভাইয়ের।
টিটো ভাই শুরুতেই শোনালেন সেইসব দিনের ক্রীড়া সাংবাদিকতার গল্প, ‘এখন তো ক্রীড়া সাংবাদিকদের সুযোগ সুবিধার অভাব নেই। অনেক ‘এলিট’ পর্যায়ে তাদের গণনা। কিন্তু আমাদের সময়টায় এমন কিছুই ছিল না। টিভি বলতে এক বিটিভি, পত্রিকাও ছিল হাতে গোনা। অনলাইন পত্রিকার কথা তো কখনো কেউ কল্পনাতেও আনেনি। সেই টিভি কিংবা পত্রিকা, সবকিছুতে ক্রীড়া সাংবাদিকতা ছিল অনেকটাই ব্রাত্য। টিভির খবরের কয়েক মিনিট, পত্রিকার এক কোনায় দুই-চার কলাম; এই ছিল খেলার খবরের অবস্থা। বিদেশ সফরে যাওয়া, বড় ছবিসহ কলাম, লিড নিউজে খেলার খবর; সবই ছিল কল্পনার মতো।’
কিন্তু সব অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন ফরহাদ টিটো। কিন্তু কি এমন জাদুবলে এমনটা সম্ভব হয়েছিল? আমাদের প্রশ্নটাও ছিল এমনই। এক কোনায় পড়ে থাকা খেলার খবরকে দৈনিক পত্রিকার লিড নিউজে আনার পেছনের রহস্যটা জানালেন তিনি নিজেই, ‘খেলার খবর মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, এটা সবসময়ই আমার মাথায় ছিল। মানুষ গড়পড়তা মানের খেলার খবর পড়তে চাইতো না। তাই ক্রীড়া সাংবাদিকতার গৎবাঁধা ধরনকেই বদলে দিতে শুরু করলাম। রান, স্কোর, ফলাফল ছাড়াও যে ম্যাচের নানা দিক নিয়ে একটু অন্যরকমভাবে খবর পরিবেশন করা যায়, সেটা আমিই প্রথম শুরু করলাম। প্রথমে একটু সংশয় থাকলেও কিছুদিনের মাঝেই সাড়া ফেললো আমার এই নতুন স্টাইল। পাঠক খেলার খবরে আগ্রহী হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে কলাম বাড়তে থাকল। একটা সময় পত্রিকার লিড নিউজে ছবিসহ উঠে এলো আমার নামসহ লেখা। খেলার খবর পত্রিকার লিড নিউজে, যা তখনকার সময়ে রীতিমত একটা বিপ্লবও বলতে পারো!’
হ্যাঁ সত্যিই সেটা বিপ্লব ছিল বটে! এখনকার দিনে সাকিব-তামিমদের খবর প্রায় প্রতিদিনই ওঠে লিড নিউজে। অনলাইন পত্রিকার সুবাদে নির্দিষ্ট পরিমাণ খবর ছাপার বাধ্যবাধকতাও নেই। তাই সকাল-সন্ধ্যা নিউজের ছড়াছড়ি, তাতে খেলার খবরটা মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। খেলার খবরকে মানুষের আগ্রহের কেন্দবিন্দুতে আনার কারিগর টিটো ভাই এই ব্যাপারটা বর্তমানে দারুণ উপভোগ করেন, ‘খেলার খবরে মানুষের আগ্রহ থাকবে, এটাই তো আমরা চেয়েছিলাম। সাকিবদের নিয়ে দেশে তো বটেই, দেশের বাইরেও নিয়মিতই আলোচনা হয়। খবর, ইন্টার্ভিউ, ভিডিও; সবকিছু দিয়েই ক্রীড়া সাংবাদিকতা এখন অন্য লেভেল পৌঁছে গেছে। আমাদের সময়ের এক পর্যায়ে লোকজন এমনটাও বলা শুরু করেছিল, পত্রিকা তো পড়া শুরুই করি খেলার পাতা দিয়ে!’
ফরহাদ টিটোর এই কথাটা আমাদের প্রজন্মের চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে! সেই ছোটবেলায় প্রথম আলো কিংবা অন্য যে পত্রিকাই হোক না কেন, দিনের শুরুতে খবরের কাগজ হাতে পেয়েই উল্টোদিক থেকে পড়া শুরু করতাম! কারণ একটাই, পেছন দিক থেকে পাতা উল্টালেই খেলার খবর। আগে খেলার পাতা পুরোটা পড়ে তারপর বাকিটা পড়া যাবে! খেলার পাতার প্রতি এই যে আলাদা একটা আকর্ষণ, সেটার জন্ম হয়েছিল টিটো ভাইদের হাত ধরেই।
মানুষের আগ্রহ বাড়ার সাথে বাড়তে শুরু করল খেলার খবরের জনপ্রিয়তাও। এই সুযোগটা বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন টিটো ভাই। পত্রিকাতে খেলার খবরের জন্য বিশেষভাবে আসতে শুরু করল বিজ্ঞাপন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশ থেকেও খেলা কাভার করতে ছুটে চললেন তিনি। ক্রিকেট কিংবা ফুটবল, কোন মাঠে টিটো ভাইয়ের পদচারনা ছিল না। আর শুধু খেলার খবর কাভার করাই নয়, এর আশেপাশে ঘটে যাওয়া অন্য খবরও সমানতালে সংগ্রহ করতেন তার দলের সদস্যরা। ফরহাদ টিটোর নেতৃত্বে এই দল যেন নতুন মাত্রা যোগ করল দেশের পত্রিকা জগতে।
কোন বিষয়টা অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছিল ফরহাদ টিটোকে? তিনি জানালেন সেই ‘গোপন মন্ত্র’, ‘সবাই এমন রিপোর্ট লিখতেন যা সব দর্শক নিজ চোখে দেখেছে। যেমন মনে করো, সাকিব বোল্ড হয়েছে। সবার রিপোর্টে এলো সাকিব এভাবে আউট হয়েছেন। কিন্তু আমি দেখতে চেষ্টা করতাম এর আগের গল্পটা। ঠিক কি কারণে সাকিব বোল্ড হলেন। আউট হওয়ার আগের কয়েক বলে সাকিব কীভাবে খেলছিলেন। বোলার কীভাবে সাকিবকে আউট করার ছক কষছিলেন। এসবই উঠে আসতো আমার রিপোর্টে। পাঠক এমন কিছু আগে কখনোই পড়েনি। তাই তারা লুফে নিয়েছিল এমন রিপোর্টকে।’
খবরের হেডিং নিয়ে আগের যুগে তেমন পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হতো না বললেই চলে। টিটো ভাই জানালেন, খবরের হেডিংয়ে আমূল পরিবর্তন আনা ছিল তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট, ‘আমাদের আগে কিংবা আমাদের সময়ে হেডিং নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না। খুব ‘ফ্ল্যাট’ হেডিংয়ের প্রচলন ছিল খেলার খবরে। কিন্তু আমি একটু অন্যরকম কিছু করার কথা ভাবলাম। আমার হাত ধরেই দেশের পত্রিকায় পাঠক পেল হেডিংয়ের নতুনত্ব। যেমন একবার কলাবাগানের সাথে বিমান বাজেভাবে হেরেছিল। অন্য সবাই সাদামাটাভাবে লিখল, বিমানের সাথে কলাবাগানের জয়। আমি লিখলাম, ‘কলাবাগানে বিমান বিধ্বস্ত!’ এমন শিরোনামে যে পাঠক কখনো খেলার খবরের দিকে তাকিয়েও দেখতো না, সেও খবরটা পড়ল! পাঠককে আকৃষ্ট করার জন্য এমন হেডিংয়ের বিকল্প আসলে নেই। সবাই যেভাবে হেডিং দেয়, সেভাবে লিখলে এত খবরের মাঝে আমারটা কেনও পড়বেন দর্শক?’
ফরহাদ টিটো যে ‘স্টাইল’ প্রবর্তন করেছিলেন, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে আধুনিক ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূলমন্ত্র। খেলার ভেতরের খবরেই পাঠক-দর্শকের আগ্রহের জায়গাটা সবচেয়ে বেশি। সাদামাটা ম্যাচ রিপোর্টের চেয়ে মাঠের ভেতরের বাইরের নানা খবর পাঠককে অনেক বেশি টানে। তিনি মানছেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সাংবাদিকদের কাজটা সহজ করে দিলেও বাড়িয়েছে চ্যালেঞ্জ, ‘সাংবাদিকতায় ‘টাইমিং’ ব্যাপারটাই সব। বিশেষ করে এই যুগে তো আরও বেশি। আমাদের সময় খবর পাঠকের হাতে পৌঁছাত একদিন পর। এখন তো সিটিজেন জার্নালিজমই সবকিছু। মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ সবকিছু লাইভ দেখতে পাচ্ছে। তাহলে মানুষ খবর কেনও পড়বে? মানুষকে তাই সঠিক সময়ে সঠিক খবরটা পৌঁছে দিতে হবে। যদি দেরি হয়েও যায়, তাহলে খবরটা শুরু হবে শেষ থেকে। ‘আপডেট’ থাকাটা সাংবাদিকতার মূলমন্ত্র। মানুষ ২ ঘণ্টা আগের পুরনো খবর কেনও নতুন করে পড়বে? তাকে জানাতে হবে এই মুহূর্তের খবর। তারপর সেখানে ধীরে ধীরে ব্যাক স্টোরি আসবে। এই ফর্মুলা মানলে কখনোই খবরের জনপ্রিয়তা হারাবে না।’
হাজারো অনলাইন মাধ্যম, শত সাংবাদিক; এসবের মাঝে নিজের স্বকীয়তা তুলে ধরবো কীভাবে; টিটো ভাইয়ের কাছে প্রশ্ন ছিল এমনটাই। তার মতে, নিজেকে আলাদাভাবে তুলে ধরার জন্য মৌলিক রিপোর্টিংয়ের বিকল্প নেই, ‘বছরের পর বছর শুধু লিখে গেলেই হবে না। এমন কিছু মৌলিক লেখা লিখতে হবে, যেন তোমার নাম শুনলেই মানুষ বলে, আরে এ তো সেই লেখাটা লিখেছিল। লেখাই হবে সাংবাদিকের পরিচয়। মানুষ লেখা মনে রাখলে স্বভাবতই মনে রাখলে লেখককেও। এইযে এত বছর পেরিয়ে গেছে, এখনো আমাকে মানুষ মনে রেখেছে। দেশে না থাকলেও, সাংবাদিকতার সাথে সেভাবে জড়িত হলেও মানুষ আজও আমাকে ৩০ বছর পুরনো খবরের হেডিংটা মনে করিয়ে দেয়! এটা সম্ভব হয়েছে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার কারণেই।’
এত কথার মাঝে হঠাৎ দেখি রাত ৮টা বাজে। ঘরে ফেরার মেট্রোরেল আর কিছুক্ষণ বাদেই বন্ধ হয়ে যাবে। আড্ডায় কোন ফাঁকে যে এত সময় পেরিয়ে গেল তা বুঝতেই পারিনি। ইচ্ছে ছিল এই আড্ডা চলতেই থাকুক। কিন্তু কোথাও তো থামতে হবে! টিটো ভাই থেকে বিদায় নিতে না চাইলেও বিদায় নিতে হলো। বুক ভরা ভালোবাসা ও দোয়ার মাধ্যমে আমাদের বিদায় বললেন। কিছুদিন বাদেই কানাডায় ফিরে যাবেন তিনি। আবার কবে দেখা হয়, কবে এমন আড্ডার সুযোগ পাওয়া যায় কে জানে। কত কথা বাকি ছিল, কত প্রশ্ন তো করাই হয়নি। সেগুলো তোলা থাক পরের বারের জন্য।
লেখক: ক্রীড়া সাংবাদিক
সারাবাংলা/এফএম