কেন সাউথ কোরিয়ার মেয়েরা সন্তান নিতে অনাগ্রহী? | চ্যানেল আই অনলাইন

কেন সাউথ কোরিয়ার মেয়েরা সন্তান নিতে অনাগ্রহী? | চ্যানেল আই অনলাইন

বিশ্বব্যাপী উন্নত দেশগুলোতে জন্মহার কম। তবে সাউথ কোরিয়ার মতো এতো কম অন্য কোথাও নেই। সাউথ কোরিয়ায় জন্মহার বিশ্বে সর্বনিম্ন, এবং এটি বছরের পর বছর আরও কমছে।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে।

সাউথ কোরিয়ার নারীরা কয়জন সন্তান ধারণ করতে ইচ্ছুক তার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে বুধবার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩ সালে আরও ৮ শতাংশ কমে ০ দশমিক ৭২-এ নেমে এসেছে এটি। তবে জনসংখ্যা স্থির থাকার জন্য সংখ্যাটি ২ দশমিক ১ হওয়া উচিত।

সন্তান ধারণ না করার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অনুমান করা যায় যে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে, কর্মক্ষম বয়সের লোকের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে, দেশের বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবায় অংশ নেয়ার যোগ্য ব্যক্তি ৫৮ শতাংশ-এ নেমে আসবে এবং প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা ৬৫ বছরের বেশি বয়সী হবে। যা দেশের অর্থনীতি, অবসর তহবিল এবং নিরাপত্তার জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। যে কারণে রাজনীতিবিদরা এটিকে জাতীয় জরুরি অবস্থা বলে ঘোষণা করেছেন।

Reneta April 2023

আশ্চর্যজনকভাবে, সাউথ কোরিয়ার নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে যে তারা তরুণদের বিশেষ করে নারীদের চাহিদার কথা শোনেন না। যা তাদের সন্তান না নেয়ার সিদ্ধান্তের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।

কোরিয়াতে বিয়ের যোগ্য ছেলে খুঁজে পাওয়া কঠিন। এমন ছেলে যে সংসারের কাজ এবং শিশুর যত্ন সমানভাবে ভাগ করে নিবে। এবং যে নারীরা সিঙ্গেল মাদার তাদের সমাজে নানাভাবে হয়রানির স্বীকার হতে হয়। বলছিলেন ৩০ বছর বয়সী ইয়েজিন। তিনি পেশায় একজন টেলিভিশন প্রযোজক।

২০ বছর বয়সের মাঝামাঝি সময়ে ইয়েজিন সমাজের রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে, একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরপর পাঁচ বছর আগে, তিনি বিয়ে না করার এবং সন্তান না নেয়ারও সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে, ইয়েজিন তার ক্যারিয়ারের দিকে মনোনিবেশ করেন।

তার মতে, সন্তানকে বড় করার জন্য তাকে যথেষ্ট সময় দেয়া গুরুত্বপূর্ণ যা তিনি তার পেশার কারণে দিতে পারবেন না। কেননা কোরিয়ান কাজের সময় তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ। ইয়েজিন আরও বলেন, আমি আমার কাজকে ভালোবাসি, এটি আমাকে অনেক পরিপূর্ণতা এনে দেয়, কিন্তু কোরিয়াতে কাজ করা কঠিন, আপনি কাজের একটি চিরস্থায়ী চক্রে আটকে থাকবেন।

সাউথ কোরিয়াতে নারী পুরুষ উভয়ই তাদের সন্তানের জীবনের প্রথম আট বছরে এক বছর ছুটি পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু ২০২২ সালে, ৭০ শতাংশ নতুন মায়ের তুলনায় মাত্র ৭ শতাংশ নতুন বাবা তাদের কিছু ছুটি ব্যবহার করেছেন।

একজন ২৮ বছর বয়সী নারী, যিনি এইচআর হিসেবে কাজ করতেন, বলেছিলেন যে- তিনি এমন মানুষদের দেখেছেন যারা তাদের চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল সন্তান নেয়ার জন্য এমনকি মাতৃত্বকালীন ছুটি নেয়ার কারণে তাদের পদোন্নতি পর্যন্ত আটকে দেয়া হয়েছিল। এসব কারণে তিনি কখনোই সন্তান নিতে আগ্রহী হননি।

কোরিয়ান নারীরা ওইসিডি অরগানাইজেশান ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ শিক্ষিত, তবুও দেশটিতে অনেক বেশি জেন্ডার পে-গ্যাপ রয়েছে এবং পুরুষদের তুলনায় নারীদের কাজের গড় অনুপাতও অনেক বেশি। গবেষকরা বলছেন যে এ ধরনের সমস্যার কারণেই নারীরা পেশা এবং পরিবারের মধ্যে ক্রমশই পেশাকে বেছে নিচ্ছেন।

স্টেলা শিন যিনি একটি আফটারস্কুল ক্লাবে পাঁচ বছরের বাচ্চাদের ইংরেজি শেখায়, কিন্তু ৩৯ বছর বয়সেও স্টেলার নিজের সন্তান নেই। তিনি ছয় বছর ধরে বিবাহিত, এবং তিনি এবং তার স্বামী উভয়েই একটি সন্তান চেয়েছিলেন কিন্তু কাজের চাপ, অর্থনৈতিক অভাব এবং নিজেদের জীবন উপভোগে ব্যস্ত থাকায় সন্তান নেবার সময়টি চলে যায়।

মায়েদের প্রথম দুই বছর তাদের সন্তানের পুরো সময় দেখাশোনা করার জন্য কাজ ছেড়ে দিতে হয়, যা আমাকে খুব বিষণ্ণ করে তোলে। আমি আমার ক্যারিয়ার এবং নিজের যত্ন নিতে ভালোবাসি। যদিও আমি সন্তান নিতে চেয়েছিলাম, নিলে হয়তো চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরিবারের উপর মনোনিবেশ করতাম, তবে সন্তান লালনে আমি আমার স্বামীর উপরেও ভরসা করতে পারি না বলেছিলেন তিনি।

এছাড়াও সন্তান লালনপালনে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ হচ্ছে সাউথ কোরিয়া। প্রাইভেট শিক্ষার খরচ ছাড়াও চার বছর বয়স থেকে শিশুদের ব্যয়বহুল অতিরিক্ত গণিত, ইংরেজি, সংগীত এবং টাইকোন্ডো ক্লাসে পাঠানো হয়। এই ক্লাসগুলো না করারও কোনো সুযোগ নেই, কেননা ক্লাসগুলো ছাড়া শিশুরা পিছিয়ে পড়ে। ২০২২ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে শুধুমাত্র ২ শতাংশ অভিভাবক প্রাইভেট টিউশনের জন্য অর্থ প্রদান করেননি, যেখানে ৯৪ শতাংশ অভিভাবকরাই বলেছেন যে এটি একটি আর্থিক বোঝা।

এই স্কুলগুলির একটিতে শিক্ষক হিসাবে, স্টেলা আর্থিক দায় সম্পর্কে অবগত। তিনি দেখেন যে পিতামাতারা প্রতি মাসে প্রতি সন্তানের জন্য ৮৯০ ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ লাখ টাকার সমান পর্যন্ত ব্যয় করেন, যাদের মধ্যে অনেকেই তা বহন করতে পারে না।

বিগত ৫০ বছরে, কোরিয়ার অর্থনীতি দ্রুত গতিতে বিকশিত হয়েছে, মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা এবং কর্মশক্তিতে প্ররোচিত করেছে এবং তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রসারিত করেছে, কিন্তু স্ত্রী এবং মায়ের ভূমিকা প্রায় একই গতিতে হ্রাস পেয়েছে।

২৭ বছর বয়সী মিনসাং জানায় আমি সন্তান ধারণ করতে চাই। আমি যদি পারতাম তাহলে ১০টি বাচ্চা নিতাম। তাকে কী বাধা দিচ্ছে জানতে চাইলে বলেন তিনি উভকামী এবং তার সমকামী সঙ্গী রয়েছে। সাউথ কোরিয়ায় সমকামী বিবাহ অবৈধ, এবং অবিবাহিত নারীদের সাধারণত গর্ভধারণের জন্য স্পার্ম ডোনারদের ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয় না।

Scroll to Top