চট্টগ্রামের তিনটি আসনে আওয়ামী মনোনীত প্রার্থীর ও মনোনয়ন বঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মাঝে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে পাল্টাপাল্টি হামলা ও আক্রমণে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) থেকে বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) রাত পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রামের তিনটি আসনে পাঁচটি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তিনটি ঘটনা চট্টগ্রাম-১৫ আসনে। বাটি দুটি ঘটনা চট্টগ্রাম-১৬ ও ১২ আসনে।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের নির্বাচনের দুই শক্তিশালী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অন্তত তিনটি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ১৫-২০ জন।
আসনটিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হয়েছেন টানা দুই বারের সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী। বিপরীতে দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সদ্য পদত্যাগ করা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মোতালেব। দুজনের দ্বন্দ্ব ও বিরোধ বহু পুরোনো।
স্থানীয় সূত্র জানায়, নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) দুপুরে সাতকানিয়া উপজেলার দক্ষিণ চরতিতে নদভীর সমর্থক সাবেক ইউপি সদস্য ইলিয়াছ শাহীনের ওপর হামলা চালানো হয়। এসময় বেশকিছু দোকানপাট ও ঘরবাড়িতেও হামলা চালানো হয়। হামলায় অভিযুক্তরা স্বতন্ত্র প্রার্থী মোতালেবের সমর্থক।
পরদিন বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে সাতকানিয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী মোতালেবের সমর্থক পশ্চিম ঢেমশা ইউপি চেয়ারম্যান রিদুয়ানুল ইসলাম সুমনের বাড়িতে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এসময় ৩টি গাড়ি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পও ভাঙচুর করা হয়। এতে অভিযুক্ত করা হয় নদভীর সমর্থকদের। পরদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় নদভীর শ্যালক চরতি ইউপি চেয়ারম্যান মো. রুহুল্লাহ চৌধুরীসহ অন্তত ৮-১০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।
আওয়ামী মনোনীত প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী বলেন, ভোটারদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী এমএ মোতালেবের নির্দেশে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। প্রশাসনকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদেরকে গ্রেফতারের জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু তারা তা করেনি। ফলে তারা এখন নির্বাচনে সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছেন। তাদেরকে গ্রেফতার করলে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটতো না। জড়িতদের দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার না করলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মোতালেবের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বায়ক ডা. আ.ম.ম. মিনহাজুর রহমান বলেন, নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরী স্থানীয় লোকজনকে কটাক্ষ করে কথা বলেছেন। তার ভাইয়ের নানা অপকর্মে এলাকার লোকজন ক্ষুব্ধ ছিল। প্রচারণা চলাকালে রিজিয়া রেজা চৌধুরীর সাথে থাকা লোকজন চরতি এলাকার দুই ছেলেকে মারধর করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে তারা জনরোষের শিকার হয়েছেন। এটা নির্বাচনী বিষয় নয়। আমরা সকল নেতাকর্মী ও সমর্থকদেরকে যে কোনো ধরনের ঝামেলা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। এটাও বলে দিয়েছি যে, কেউ কোনো ঘটনা করলে এটার দায় প্রার্থী নিবেন না।
সাতকানিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রিটন সরকার বলেন, আমাদের সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। গত ১৯ ও ২০ ডিসেম্বরের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনটিতে বুধবার ২০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমান ও নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সমর্থকদের মধ্যে মধ্যে ধুলা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এঘটনায় ওইদিন রাতে বাঁশখালী থানায় ৯ জনের নাম উল্লেখসহ ২০-৩০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন নৌকার প্রার্থীর সমর্থক হারুনুর রশিদ। দুদিন পর এসে শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে মোস্তাফিজুর রহমানের ১১ সমর্থকের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৩০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করে পাল্টা আরেকটি মামলা করেন মুজিবুর রহমানের সমর্থক বেলাল উদ্দিন।
এরমধ্যে ঘটনার পরপর উভয় প্রার্থীর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আবু সালেম মোহাম্মদ নোমান। চিঠিতে বলা হয়েছে, ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে স্থানীয় এমপি ও নৌকার প্রার্থী বাঁশখালী পৌর সদরে অবস্থিত আওয়ামী লীগ কার্যালয় থেকে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে বের হন। একই সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমানের একদল সমর্থক উত্তর দিক থেকে আসলে উভয় পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ধুলা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে রনি দাশ ও জসিম উদ্দিন নামে দুই ব্যক্তি আহত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। এই ঘটনায় মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীকে ২৩ ডিসেম্বর বেলা ২টায় নিজে অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে ব্যাখ্যা দিতে চিঠি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমানকে একই দিন দুপুর ১২টায় নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের সামনে নিজে অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে আদেশ দেওয়া হয়েছে।
এই বিষয়ে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান আবু সালেম মোহাম্মদ নোমান জানান, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির নজরে আসার পর এই ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। উভয় প্রার্থীর কাছ থেকে ব্যাখ্যা পাওয়ার পর এই বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া): বুধবার (২০ ডিসেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য এবং জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর গণসংযোগের গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই প্রার্থীর কর্মীদের অভিযোগ, হামলায় তার ১০ থেকে ১৫ জন সমর্থক আহত হয়েছেন। এসময় গণসংযোগে নিয়োজিত সামশুল হক চৌধুরীর গাড়িসহ মোট ছয়টি গাড়ির চাকার টায়ার কেটে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
ওইদিন বিকেল ৪টার দিকে উপজেলার কাশিয়াইশ ইউনিয়নে সামশুল হক চৌধুরী গণসংযোগে গেলে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার জন্য সামশুল হক চৌধুরী আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর সমর্থকদের দায়ী করেছেন। আসনটিতে সামশুল হক এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।
এঘটনায় বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরী। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, বুধবার বিকালে আমি পটিয়ার কাশিয়াইশ ইউনিয়নে গণসংযোগে গেলে সেখানে কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করেন মোতাহেরুল ইসলামের অনুসারীরা। তারা আমার প্রচারণার ছয়-সাতটি গাড়ির টায়ার কেটে দেন। প্রকাশ্যে রামদা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালান। এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেছেন। একজন ইউপি চেয়ারম্যান এই হামলার নেতৃত্ব দেন। আমরা এসব ঘটনা নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশ প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। একটি ঘটনায় ইতোমধ্যে মামলা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ভোট যতই ঘনিয়ে আসছে নৌকার অনুসারীরা ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে মোতাহের ও তার অনুসারীদের এসব কর্মকাণ্ড বন্ধের অনুরোধ জানাচ্ছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে জোর দাবি জানাই।
এবিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী তার লোকজনকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এর সঙ্গে আমার কেউ জড়িত নয়। তার লোকজন আমাদের কর্মী-সমর্থকদের প্রতিনিয়ত হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছে। এমনকি ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে নানা ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।