আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে স্থাপত্যশিল্পে সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছেন স্থপতি কাজী রাকিব। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর রয়েছে ‘আইডি এ ইন ডেপ্থ আর্কিটেক্টস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এবং প্রধান স্থপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন করেছে। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে এই স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
ভবনে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল যে কোনো ভালো স্থাপত্যের অন্যতম পূর্বশর্ত। স্থাপত্যের ব্যবহারিক দিকটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে প্রয়োজনে স্থাপনাটি নির্মিত হচ্ছে, ব্যবহারকারীরা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে তা ব্যবহার করতে পারেন সেটা সর্বোচ্চ বিবেচনায় রাখতে হবে। কোনো জটিলতা নয় বরং সরল এবং জুতসই নির্মাণ কাঠামো আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। স্থাপত্যের ভাষা প্রকাশের ক্ষেত্রে আধুনিকতা আমার পছন্দ। কথাগুলো বললেন স্থপতি কাজী রাকিব। চার ভাইবোনের মধ্যে রাকিব সবার বড়। তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলায়। রাকিবের বাবার নাম কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন (মৃত) তিনি স্বনামধন্য একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। মা মোসাম্মৎ রহিমা বেগম গৃহিণী। স্কুল জীবন থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ডিবেট ফোরামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাকিব। লেখালেখি করতেন। ছবি আঁকাআঁকিতে পারদর্শী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই আর্কিটেকচারের প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায়। সেই ভালোবাসা থেকেই আজ তিনি হয়েছেন সফল একজন স্থপতি।
বরিশালের খানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন ২০০১ সালে। ২০০৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে। ২০১০ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাশ করে বের হওয়ার পরপরই তিনি যোগ দেন আকৃতি কনসালটেন্ট ফার্মে। ২০১২ সালে স্থপতি কাজী রাকিব নিজেই গড়ে তোলেন ‘আইডি এ ইন-ডেপ্থ’ আর্কিটেক্টস নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পার্টনার হিসেবে আছেন বন্ধু স্থপতি সিফাত আহমেদ মুনিম ও স্থপতি ইসমত জেবীন।
তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে গাজীপুরে সূবর্ণ মসজিদ, নিকুঞ্জ-১ এ কাজী বাড়ি ত্রিপ্লেক্স বিল্ডিং, গাজীপুর চন্দ্রায় হাজী মোহাম্মদ আলী সুপার মার্কেট (মিক্সড ইউজড ইনফাস্ট্রাকচার), কালিয়াকৈর চন্দ্রায় হাজী বাড়ি ডুপ্লেক্স বিল্ডিং, সাভারে মাটির বাড়ি (রেস্টুরেন্ট ও লাইব্রেরী), ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সিএমএইচ অফিস ওয়ার্ড, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় দ্য রিভারাইন, বিইআরসি হেড অফিস, কম্পিটিশন এন্ট্রি, ঢাকায় কন্ডমিনিয়াম, সেগুনবাগিচায় এন এস আই প্রোপসড মসজিদ, মানিকগঞ্জে কর্পোরেট অফিস, মিরপুর ডিওএইচএস-এ ব্রিগ. জেন. তাসনিম রেসিডেন্স, ব্রিগ. জেন. মেহবুব রেসিডেন্স, রংপুরে ৯তলা রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিং, নেস্টলে বাংলাদেশ এর রেনোভেশন কাজ, রূপগঞ্জে ভ্যাকেশন হাউজ, সাভারে ইডেন গার্ডেন রিসোর্ট, চট্টগ্রামে জাতির পিতা ভাস্কর্য, নরসিংদীতে বাইলাইন মসজিদ, সাভারে বাঙ্কুয়েট হল, আইডিসিওএল হেড অফিস কম্পিটিশন এন্ট্রি, আইইবি কনভেশন সেন্টার কম্পিটিশন এন্ট্রি, বিল্ট বিডি এ ফর ডেবল হাউজিং কম্পিটিশন এন্ট্রি, ঢাকা, খুলনা সহ বিভিন্ন জায়গায় রোডস ও হাইওয়েজ এর বাংলো, যশোরে বায়তুল আমান মসজিদ, হবিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা মেমোরিয়াল, মাধবপুরে বাংলো, নাটোরে মিক্সড ইউজড বিল্ডিং সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন তিনি। এছাড়াও বর্তমানে বেশ কয়েকটি নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন।
সম্পর্কিত

গাজীপুর অবস্থিত নান্দনিক সূবর্ণ মসজিদ। এই স্থাপনাটি সম্পর্কে স্থপতি রাকিব বলেন, সূবর্ণ মসজিদ একটি ব্যতিক্রমী স্থাপত্যের নিদর্শন যা আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী উপাদান গুলোর সুনিপুন মিশ্রণে তৈরি। এটি বাংলাদেশে অবস্থিত একটি অত্যাধুনিক মসজিদ, যা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অর্থায়নে এবং বাংলাদেশ রোডস এন্ড হাইওয়ে বাস্তবায়ন করেছেন। সূবর্ন মসজিদের নকশায় ইসলামিক স্থাপত্যে ঐতিহ্যকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো লাল ইটের খিলানযুক্ত ফ্যাসাদ, যা ঐতিহ্যবাহী বাংলার প্রাচীন মসজিদের নকশায় স্মৃতিচারণ করে। মসজিদের সম্মুখভাগে খিলান আকৃতির বড় খোলা জায়গা গুলো ইসলামি স্থাপত্যে সাধারনত ব্যবহৃত মিহরাবের প্রতিচ্ছবি বহন করে। লাল ইটের ব্যবহার মসজিদটিকে প্রাকৃতিক এবং টেকসই উপাদান দিয়ে পরিবেশবান্ধব করে তুলেছে।
কন্ডোমিনিয়াম বিল্ডিং সম্পর্কে স্থপতি রাকিব বলেন,
কন্ডোমিনিয়াম, গুলশান লেক সংলগ্ন এ অবস্থিত। যেখানে ১৩৪টি আবাসিক ইউনিটের সাথে সামাঞ্জসপূর্ণ নাগরিক সুবিধাদি যেমন- জিমনেশিয়াম, পাঠাগার, ক্যাফে, সুপার শপ, সুইমিংপুল, প্রসস্থ লিফট-লবি, সিড়ি, আবশ্যিক উম্মুক্ত স্থান, শিশুদের জন্য আলাদা পার্ক ইত্যাদি প্রস্তাব করা হয়েছে। সেই সাথে প্রতিটি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় যথেষ্ট পার্কিং (বেজমেন্ট ঢ ০২), অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আপদকালীন বহিঃগমন (বসবৎমবহপু বীরঃ) ব্যবস্থা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
২০২৩ সালে রাকিব বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম ইসমত জেবীন। তিনিও একজন আর্কিটেক্ট। স্থপতি কাজী রাকিব বলেন, ভূমি ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা নির্দিষ্ট পরিমানের ভূমিতে অনির্দিষ্ট পরিমানের চাহিদাকে সংকুলান করার কঠিন পরীক্ষাটা স্থপতি মাত্রই দিতে হয়। এক্ষেত্রে একজন স্থপতি হিসেবে শুরুতে আমরা ক্লাইন্ট এর কথা শুনতে চাই। প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে স্ট্যান্ডার্ডের সাথে সমন্বয়, সেই সাথে স্থাপনার ভৌগলিক অবস্থান, পরিবেশে ও জলাশয়, আবহাওয়া-জলবায়ু বিবেচনায় একটা আরামদায়ক ও কার্যকরী কর্ম পরিবেশ ও বাসস্থান নকশা করার চেষ্টা করি। পুরো পদ্ধতিতেই বিভিন্ন সময়ে সংগৃহীত তথ্য ও উপাত্ত বিবেচনায় একটি কার্যকারী ও নান্দনিক স্থাপনা নকশা ও বাস্তবায়ন করার এই ধারাটা আমরা উপভোগ করেই কাজ করতে চাই, যেন আমাদের আভ্যন্তরীন টিম ও ক্লাইন্ট/ইউজার গ্রুপের মধ্যে যোগাযোগ আরো সমৃদ্ধ থাকে। যা কোনো কাজকে সফল বা ব্যবহার যোগ্য করে তুলতে সাহায্য করে।কার্যকারিতা ও নান্দনিকতা, যে কোনো স্থাপনার সফল ব্যবহার নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ স্থান ব্যবহারের দক্ষতা এর সাথে নান্দনিকতার সমন্বয় করা গেলে যে কোনো স্থাপনার মূল লক্ষ্য নিশ্চিত করা যায়। এর সাথে অনেক গুলো বিষয়কে একত্র করা জরুরী হয়ে পরে। যেমন- প্রাকৃতিক আলো, বাতাসকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্যকর বিল্ড এনভায়রনমেন্ট নিশ্চিত করা। একই সাথে বিদ্যুত ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার সাশ্রয়ী করা। এভাবে ছোট পরিসর থেকে বড় পরিসরে একটু একটু করে সাশ্রয়ী হওয়া গেলে সামগ্রীকভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং এনার্জি ব্যবহারের উপর চাপ কমে আসবে। সেই সাথে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় উপকরণের ব্যবহারে নির্মাণে ব্যয় সংকুচিতি করার পাশাপাশি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে সাস্টেইনাবল ডিজাইন গোল নিশ্চিত করা।
ব্যক্তিগতকৃত নকশা পদ্ধতি, ইউজার গ্রুপ বিবেচনায়, স্থান কাল ভেদে প্রত্যেকটা পরিসর তার ভিন্নতা ও স্বকীয়তা অক্ষুন্ন রাখতে আলাদা যত্নের দরকার হয়। সে ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী, ব্যবহারের ধরণ, বয়স, বিবেচনায় বিশেষায়িত নকশা করার প্রয়োজনে আদর্শ মেনে নিয়ে যুক্তি যুক্ত আরগনোমিক্স নিশ্চিত করা গেলে, স্পেস এর ব্যবহার আরো কার্যকারী করা যায়। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সমস্যাগুলোর অভ্যন্তর থেকে সমাধান খুঁজে নিজেই নিরলসভাবে ‘আইডি এ ইন ডেপ্থ আর্কিটেক্টস’ কাজ করতে চায়। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি কাজে নজর দেন রাকিব। পাশাপাশি পেশার কাছে দায়বদ্ধ থেকে সেটাকে সততার সঙ্গে শেষ করতে তৎপর থাকেন সবর্দা।