প্রাককথন
কয়েক বছর আগের কথা। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আনন্দ আলোয় কাভার স্টোরি প্রকাশ করা হবে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলোচিত নারীদের নিয়ে কাভার স্টোরি লেখার সিদ্ধান্ত হল। তালিকা প্রায় প্রস্তুত। বেসরকারি টেলিভিশনে খ্যাতিমান হয়ে ওঠা ব্যাপক আলোচিত একজন নারী সাংবাদিকের সঙ্গে আমি নিজেই যোগাযোগ করলাম। বয়সে আমার চেয়ে জুনিয়র। ফোনে বললাম, তোমার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই। ওই নারী সাংবাদিক একটু যেন অবাক হলো। বললো, আমার সাক্ষাৎকার নিতে চান? কি বিষয়ে? উপলক্ষ কী?
তাকে বললাম, উপলক্ষ আন্তর্জাতিক নারী দিবস…
আমাকে থামিয়ে দিল সে। অনেকটা ক্ষোভের সুরে বলল, রেজা ভাই আপনি কী আমাকে নারীর বাইরে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারলেন না?
আমি যারপর নাই অবাক। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও তো কথা বলা উচিৎ। এখানে ‘মানুষ’ প্রসঙ্গ আসছে কেন? তর্ক করলে করাই যায়। কিন্তু আমি কোনো তর্কে গেলাম না। শুধু বললাম, বিষয়টা যেহেতু আন্তর্জাতিক নারী দিবস তাই তোমার সঙ্গে কথা বলার কথা ভেবেছি। তুমি কথা বলতে না চাইলে অসুবিধা নাই। তুমি কী কথা বলতে চাও না?
ওই নারী সহকর্মী বলল, আমাকে মাফ করবেন। আমি নারী-পরুষের মধ্যে বিভাজন চাই না। আমি নারী একজন মানুষ। পুরুষও একজন মানুষ। কাজেই আলাদা করে নারী দিবসের প্রয়োজন দেখি না।
আবারও বলি, তর্ক করলে করাই যেত। কিন্তু তর্কে যাইনি। তবে বিষয়টি আমার মাথায় গেথে গিয়েছিল। পরের বছর নারী দিবস উপলক্ষে আনন্দ আলোয় শীর্ষ কাহিনী প্রকাশ হল। সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ওই সংখ্যায়। হঠাৎ একদিন শুনলাম আনন্দ আলোর ওই প্রতিবেদনে বিশিষ্ট নাট্যকার ফারিয়া হোসেনের কোনো কথা না থাকায় তিনি মনঃক্ষুন্ন হয়েছেন। আনন্দ আলোর অধিকাংশ শীর্ষ কাহিনী বিভিন্ন পত্রিকায় প্রায় হুবহু প্রকাশ হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে আপলোড করেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আনন্দ আলোর ওই শীর্ষ কাহিনীতে ফারিয়া হোসেনের কন্যা মায়ের ব্যাপারে কোনো তথ্য না পেয়ে মাকেই প্রশ্ন করেন, মা তুমি কেমন নাট্যকার? এই যে দেখ আনন্দ আলোর প্রতিবেদনে নারী নাট্যকার হিসেবে তোমার নাম নাই। ভেরি স্যাড…
এই তথ্যটি দিয়েছেন জনপ্রিয় নাট্য নির্মাতা চয়নিকা চোধুরী। তার বক্তব্য, আনন্দ আলোর ওই কাভার স্টোরিতে নারী নাট্যকার তালিকায় নিজের নাম দেখে ফারিয়া হোসেন যার পর নাই অবাক হয়েছেন। চয়নিকার ইচ্ছে ফারিয়া হোসেন ও চয়নিকার যুগলবন্দী একটি সাক্ষাৎকার আনন্দ আলোয় প্রকাশ হোক। কারণ ইতিমধ্যে তাদের যৌথ উদ্যোগে প্রায় ২ শতাধিক নাটক টেলিফিল্ম নির্মিত হয়েছে। যার লেখক ফারিয়া হোসেন। আর নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী। অর্থাৎ ফারিয়া নাটক লেখেন, চয়নিকা সেই নাটক বানান। নাট্যকার আর নাট্যনির্মাতার এমন যৌথবদ্ধ প্রয়াস দেশে বোধকরি প্রথম।
সিদ্ধান্ত হল চয়নিকা আর ফারিয়া হোসেনের মুখোমুখি বসবেন আনন্দ আলোর সম্পাদক। একদিন সকালে ফারিয়া হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দ আলো কার্য্যালয়ে এলেন চয়নিকা চৌধুরী। আমি একটু দ্বিধাগ্রস্থ। ফারিয়া হোসেনকে কী নারী নাট্যকার বলব?
প্রসঙ্গ তুললাম- ফারিয়া আপনাকে কী নারী নাট্যকার বলব?
ফারিয়া হোসেন একটুও ভাবলেন না। বরং দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, অবশ্যই আমি একজন নারী নাট্যকার? এটা আমার গর্ব। আমি নিজেকে নারী নাট্যনির্মাণ করে, নির্মাতা ভাবতেই পছন্দ করি।
কথা পরিস্কার। আমাদের আনন্দ মুখর আড্ডা শুরু হয়ে গেল।
আনন্দ আলো: ফারিয়া হোসেন। আপনাকে কী নারী নাট্যকার হিসেবে পরিচয় দিতে পারি?
ফারিয়া হোসেন: কেন না? আমি একজন নারী। এজন্য আমি গর্বিত।
আনন্দ আলো: (চয়নিকা ও ফারিয়ার উদ্দেশে) আমরা তাহলে নারী নির্মাতা, নারী নাট্যকার হিসেবেই আজকের আড্ডা এগিয়ে নেব?
ফারিয়া হোসেন: আমি ফারিয়া হোসেন, পাশে বসে আছেন চয়নিকা চৌধুরী। প্রিয় বৌদি। আমরা দু’জন নারী হিসেবে খুবই প্রাউড ফিল করি। ইয়েস উই মিন ইট। আমাদের দু’জনকে নিয়ে কথা হলে নারী ব্যাপারটা আসবেই।
আনন্দ আলো: চয়নিকা কী বলবেন?
চয়নিকা চৌধুরী: ফারিয়ার সঙ্গে আমি সম্পুর্ন একমত। নির্মাতার জেন্ডার হয় না। বাট আমি খুবই প্রাউড ফিল করি যে আমি একজন নারী। নারী হিসেবেই কাজ করছি সমান তালে পুরুষের সঙ্গে। আমি নিজেকে একজন সংগ্রামী নারী মনে করি। আমি একজন মা, আমি একজন স্ত্রী। আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশটাই তো মা। সেই মা আমিও… আমাকে যখন কেউ বলে নারী নির্মাতা, খুব প্রাউড ফিল করি।
আনন্দ আলো: ফারিয়া হোসেন আপনার শুরুটা কীভাবে?
ফারিয়া হোসেন: সাংবাদিকতার মাধ্যমে আমার কর্মজীবন শুরু। ১৭ বছর বয়সে শুরু করেছিলাম। প্রথমে বিচিত্রা পরে আনন্দ বিচিত্রায়… একটা সময় বিটিভিতে যাওয়ার সুযোগ হল। কাজী জাওয়াদ ভাই তখন বিটিভিতে হাই প্রোফাইল কুইজ শো করতেন। তিনি আমাকে অনুষ্ঠানটির সহ উপস্থাপক হবার প্রস্তাব দিলেন। আমি রাজি হইনি। আমি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। জাওয়াদ ভাই বোধকরি আমাকে উসকে দিতে চাইছিলেন। বললেন, উপস্থাপনা পারবেন না বলে বোধকরি সাহস করছেন না?
জাওয়াদ ভাই ভুল বলছেন এটা প্রমান করার জন্য আমি ওই কুইজ শোর উপস্থাপক হতে রাজি হলাম। প্রথম অনুষ্ঠান করলাম। সবাই প্রশংসা করলো। তারপর বেশ কিছু পর্ব প্রচার হল। জাওয়াদ ভাই বিবিসিতে যোগ দিতে দেশ ছাড়লেন। বিটিভির প্রোগ্রামটা বন্ধু হয়ে গেল।
সময়টা বোধকরি ১৯৯৪। আনন্দ বিচিত্রায় প্রায়শই অরুণ চৌধুরী অর্থাৎ আমাদের অরুণদাকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে নাটক লিখতে দেখতাম। আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার নাটক লেখা দেখতাম। ঈদের ৩ দিনের ছুটিতে আমিও একটা নাটক লিখে ফেললাম। নামÑ অভিমান। প্যাকেজের যুগ তখনও শুরু হয়নি। প্রয়াত মোস্তফা কামাল সৈয়দ তখন বিটিভির জিএম ছিলেন। আমার বাবার সূত্র ধরে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তার কাছে নাটকটি জমা দিলাম। পান্ডুলিপির দিকে চোখ চুলিয়ে বললেন, রেখে যান। পরে সিদ্ধান্ত জানাব।
কয়েকদিন পর বিটিভিতে গেলাম। তিনি বললেন, আপনার এই নাটক আমাদের পক্ষে বানানো সম্ভব হবে না। মডেলিং, নাচ, গান ছিল আছে নাটকের কাহিনীতে। অনেক গ্লামার লাগবে। তিনি বললেন, অচিরেই বিটিভিতে প্যাকেজ নাটক প্রচার শুরু হবে। আপনি বরং প্যাকেজের আওতায় নাটকটি বানানোর কথা ভাবেন। কথায় কথায় তিনি আমাকে বিটিভিতে একটা অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব দিলেন। জনপ্রিয় তারকাদের নিয়ে অনুষ্ঠান। মৌ, বিপাশা ও মৌসুমীকে নিয়ে বিটিভির জন্য একটা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করলাম। এরই ধারাবাহিকতায় বিটিভিতে অমি ব্যতিক্রম ধর্মী আরও কিছু ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছি। যখনই প্যাকেজ অনুষ্ঠান নির্মাণের ঘোষণা এলো তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর ক্যামেরার সামনে দাঁড়াব না। প্রোডাকশন হাউস করলাম মৌ ও টনি ডায়েসকে নিয়ে। আমার লেখা ও ডিরেকশনে ‘অভিমানে অনুভবে’ নামে আমার প্রথম নাটক নির্মিত হলো। মৌ এবং টনি ভায়েসের প্রথম অভিনয়ও প্রথম প্যাাকেজ নাটক।
আনন্দ আলো: চয়নিকা, আপনার শুরুটা কেমন ছিল?
চয়নিকা চৌধুরী: শুরুটা হঠাৎ করেই। কিছু একটা করতে হবে এই ভাবনায় ১৯৯৫ সাল থেকে আমি লিখতে শুরু করি। আমার প্রথম লেখা নাটক পড়তে দিয়েছিলাম অরুণ চৌধুরীকে। অরুণ চৌধুরী সাফ কথা জানিয়ে দিলÑ এই নাটক সে পড়বে না। একটা যুক্তি দাঁড় করাল। অরুন যদি আমার নাটক পড়ে সংশোধন করে দেয় তাহলে ভবিষ্যতে আমি হয়তো তার উপর নির্ভরশীল হয়ে যাবো। এই ঘটনায় আমি কিছুটা মানসিক ভাবে আঘাত পেয়েছি। কেঁদেছিও। পাশে মুখোমুখি বিল্ডিং এ থাকতো বিপাশা হায়াত। তাকে নাটকটা পড়তে দিলাম। তখনকার দিনে আজকের দিনের মতো মোবাইল ফোন ছিল না। নাটক পড়ে বিপাশা তাদের বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাকে বললোÑ নাটক অসাধারন হয়েছে। আমি অভিভূত। মনে হল আমি পারব। জীবনের প্রথম লেখা নাটক। নাম ‘বোধ’। মজার ব্যাপার হলো আমার জীবনের প্রথম লেখা নাটকটি বানিয়েছিলেন ফারিয়া হোসেন। আমার প্রথম নাটকের ডিরেক্টর। আরও মজার ব্যাপার আমি এখন তার লেখা নাটকের ডিরেক্টর। আমাদের যৌথ নাটকের সংখ্যা ইতিমধ্যে ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। একটা কথা বলি ফারিয়া হোসেন তখনকার দিনে নির্মাতা হিসেবে অনেক আলোচিত ছিলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে তার বানানো নাটক দেখতাম।
ফারিয়া হোসেন: (চয়নিকার কথার প্রেক্ষিতে) রেজানুর ভাই আমার ধারনা আমি সময়ের চেয়ে একটু এডভান্স ছিলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যা স্বাভাবিক ভাবে দেখা যায় আমি তা একটু অন্যভাবে দেখাব। আমি অনেক গুণী মানুষের সহায়তা পেয়েছি। যেমন বলু ভাইয়ের কথা বলি। ক্যামেরার জাদুঘর। আমার গুরু আফজাল হোসেনের কথা বলি। তাঁর কাজ দেখে মুগ্ধ হতাম। আমরা আসলে বিটিভির প্রচলিত ধারার নাটক বানাতে চাইনি। সেটা আমরা করে দেখিয়েছি।
চয়নিকা চৌধুরী: আমার শুরুর দিকের কথাটা আরেকটু বলি। জীবনের একটা সময়ে আমি দারুণ ক্রাইসিসে পড়ে যাই। নাটক লিখছি। একদিন লাইট অ্যান্ড শ্যাডোর মালিক মুজিবের কাছে আমার লেখক সম্মানী আনতে গেছি। ৮ হাজার টাকা দিল। একটি নাটক লেখার সম্মানী। টাকাটা নিয়ে চলে আসছিলাম। গেটের কাছে এসে কী ভেবে যেন ফিরে এলাম মুজিবের কাছে। তাকে জিজ্ঞেস করলামÑ আমার এই নাটকের ডিরেক্টর কে? এই প্রশ্ন করার কারণ হলো আমি নাটকের স্যুটিং দেখতে যাবো। আমি শিখতে চাই। আমার প্রশ্ন শুনে মুজিব বলল, আপনার নাটকের ডিরেক্টর তো আপনি।
আমি দাঁড়িয়েছিলাম। অবাক হয়ে পাশেই চেয়ারে বসে পড়লাম। মুজিবকে জিজ্ঞেস করলাম- আমি কী পারব?
মুজিব বলল, অবশ্যই পারবেন। ছোটবেলা থেকেই আপনি ক্যামেরা, লাইট অ্যাকশনের জগতেই আছেন। কাজেই আপনিই পারবেন।
ব্যস, আমার নির্মাতা জীবন শুরু হয়ে গেল। তবে একটা সমস্যা দেখা দিল। নাটক ভালো হলে দুর্মুখেরা বলে অরুণ চৌধুরী লিখে দিয়েছে। নাটক বানাব। ক্যামেরায় থাকবেন আনোয়ার হোসেন বুলু। তখন হয়তো দুর্মুখেরা বলতে শুরু করবে বুলু ভাই সব কাজ করে দিয়েছেন। তাই বেশ সতর্ক হলাম। অ্যাডি হিসেবে একটি মেয়েকে নিলাম। বুলু ভাইয়ের অ্যাসিস্ট্যান্টকে ক্যামেরাম্যান হিসেবে নিলাম। সমস্যা হল জনপ্রিয় কোনো হিরো আমার নাটকে অভিনয় করতে রাজি হচ্ছে না। কারণ আমার উপর তাদের আস্থা তৈরি হয়নি। প্যাকেজের যুগ। প্যাকেজ মানেই তো এক অর্থে সিনেমা। সিনেমার মতো নাটক হচ্ছে। ইশিতাকে পেলাম। জয়া আহসানকে পেলাম। বাবার চরিত্রে আবুল হায়াত আংকেলকে পেলাম। হিরো কাউকেই পাচ্ছিলাম না। সিজার নামে একজন তরুণ অভিনেতা, ইতিমধ্যে কয়েকটি নাটকে টুকটাক অভিনয় করেছে। তাকে একটি চরিত্রে নিলাম। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় নাট্য নির্মাতা সতীর্থ রুবেল সেই সময় ততটা পরিচিত ছিল না। তাকে নায়ক হিসেবে কাস্ট করলাম। ২০০১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নাটকটির প্রথম স্যুটিং শুরু করি।
আনন্দ আলো: ফারিয়া হোসেন আপনার কাছে এবার একটি প্রশ্ন করি। একজন নারী নির্মাতা হিসেবে একটা সময় বেশ দাপট দেখিয়েছেন। কীভাবে তা সম্ভব হয়েছিল?ফারিয়া হোসেন: আমার শুরুটা সাংবাদিকতার মাধ্যমে। আমার জন্য ওইটা একটা এডভানটেজ ছিল। কারণ মিডিয়ার সবাই আপা ডাকতো। এখনকার কথা বলব না। তখনকার দিনে জার্নালিস্টদেরকে সবাই বেশ সম্মান, সমীহ করতো। আমি একটু ঠ্যাটা, একটু বোল্ড। একটু বেয়াদবও ছিলাম। তাই আমাকে সহজেই কেউ ঘাটাতে চাইত না।
আনন্দ আলো: না আমাদের পত্রিকাটা এমন ছিল না। বাইরের লোকরা ঘাটাত না। নিজেদের লোকেরাই বরং ঘাটাত।
ফারিয়া হোসেন: প্রথম নাটক করার সময় আমার জমানো কিছু টাকা ছিল। বাবার কাছে কিছু টাকা ঋণ নিলাম। আমি নিজে প্রডিউসার হলাম। আমি যখন নাটক বানাতাম তখন সবাইকে বলে দিয়েছিলাম, ভুল হোক, ঠিক হোক এভরি শর্ট ইজ মাইন। আনোয়ার হোসেন বুলু ভাইয়ের কথা বারবারই আসে। তাকে মনে হতো সর্বংসহা মাটি। একদিন বুলু ভাইকে বললাম, আমি সিনগুলো যেন দেখতে পারি। আমি কিছুই জানতাম না। কাজ করতে করতে শিখেছি। আমি ভিসিআরএ প্রায় প্রতিদিনই রাতে বিশ্বখ্যাত নির্মাতাদের সিনেমা দেখতাম। বলতে পারেন দেখতে দেখতেই আমি শিখেছি। কীভাবে স্ক্রীপ্ট লিখতে হয়, শর্ট ডিভিশন করতে হয়? নির্মানের সকল ভাষা ও কৌশল সিনেমা দেখতে দেখতেই শিখেছি। এছাড়া তো কোনো উপায় ছিল না।
এখন আমি নির্মাণ করি না। তবে লেখা ছাড়িনি। লিখতে না পারলে অস্থির লাগে। মনে হয় আমার যে কাজ আমি তা করছি না।
আনন্দ আলো: চয়নিকা আপনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাটা কেমন ছিল?
চয়নিকা চৌধুরী: আমার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা এখনও আছে। পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাকে আমার কাজ করতে হবে এই রিকসটা শুরু থেকেই ছিল। আমি খুব বোল্ড চরিত্রের মানুষ। প্রতিপক্ষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলি। আমি এটা চাই। কাজেই আমি এটা করবই…
আনন্দ আলো: চয়নিকা আপনাকে একটা বিব্রতকর প্রশ্ন করি? অনেকে বলে থাকেন চয়নিকা চৌধুরীর নাটক অন্য কেউ বানিয়ে দেয়। এরকম অভিযোগ কী আপনি শুনেছেন?
চয়নিকা চৌধুরী: আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ অনেক পুরোনো। বহুত পাইছি।
ফারিয়া হোসেন: আমিও এমন অভিযোগ শুনি। নারী নির্মাতাদের কাজ নাকি পুরুষেরা করে দেয়। কারণ নারী সংসার সামলায়। তার আরও অনেক কাজ। নাটক নির্মাণ তার পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ করে দেয়…
চয়নিকা চৌধুরী: এই যে করে দেয় অভিযোগ, কে করে দেয়? একথা শুনলে আমার বেশ হাসি পায়। যখন নাটক লিখতাম তখন অভিযোগ উঠলো অরুণ চৌধুরী লিখে দেয়। প্রুভড করব কীভাবে? একটা সেটে তো অনেক মানুষ থাকে। তারা কী দেখে না কাজটা কে করছে। কে বানাচ্ছে? একবার দুইবার হলে না হয় কথা ছিল। ২৪টা বছরে আমার শত শত নাটক অন্যেরা বানিয়ে দিয়েছে? একথা যারা বলে তারা বোকা। ঈর্ষা থেকে একথা বলে।
ফারিয়া হোসেন: আমার ক্ষেত্রেও এমনটা বলা হতো। চয়নিকার স্বামী নামকরা নাট্যকার। তিনি না হয় চয়নিকাকে নাটক লিখে দেন। আমার তো এরকম কেউ নাই। কাজেই আমার নাটক অন্যে লিখে দেয়। অন্যে বানিয়েও দেয়… এরকম কত কথা যে শুনতে হয়েছে। আমি কোনো কথাকেই গ্রাহ্য করতাম না। উত্তর দিতাম না। কাকে উত্তর দিব? একজন আর্টিস্টের কথা বলি। তার নাম উল্লেখ করতে চাই না। তিনি একদিন বললেন, ফারিয়া তো নিজে নাটক বানায় না। অন্যে বানিয়ে দেয়। ওই লোক একদিন নিজে এসে আমার সঙ্গে একটা নাটক করতে চাইল। তার মন্তব্যÑ আপনি তো আপনার নাটকে আমাকে কাস্ট করবেন না। আমি একটা নাটক প্রডিউস করছি। এই নাটকে আপনি আমাকে অভিনয়ের সুযোগ দেন। আমি তাকে অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছি। সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে আমার নাটক আমিই বানাই।
চয়নিকা চৌধুরী: প্রসঙ্গক্রমে আমি একটা কথা বলি। যা ছিল অনুভবে আমার এই নাটকে টনি ডায়েস প্রথম অভিনয় করছে। টনি সঙ্গে আমার বন্ধুর সম্পর্ক। স্যুটিং শুরুর আগে আমাকে বললোÑ পাবো কিছু?
আমি মৃদু হেসে বললাম- কি জানি… আমি পারি নাতো…
নাটকের স্যুটিং হল। খামে পেমেন্ট দিলাম। যাবার জন্য গাড়িতে উঠলো। পরক্ষনেই গাড়ি থেকে নেেেম এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বন্ধু গ্রেট জব। এটা আমার জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
এই জেনারেশনের অনেকে আমার সঙ্গে কাজ করে। ওদের ম্যাসেজে অনেক টেক্সট যায়। ‘করবা না। উনি কিন্তু কিছুই পারে না। উনি ভালো না। অ্যাই সেই, হ্যান ত্যান….’ বুঝায়। তারা কাজের সময় কিছুই বলে না। কিন্তু কাজ করে (অভিনয়) যখন যায় তখন ‘গুড জব’ কথাটিই বলে যায়। তাদের মন্তব্য। দিদি বাইরের মানুষ আপনার সমন্ধে এত কিছু বলে যে, মাঝে মাঝে কনফিউজড হয়ে যাই। অথচ আপনার সঙ্গে কাজ করে বুঝলাম সব কথা ভুয়া। থ্যাংকস এজন্য।
ফারিয়া হোসেন: আজকে একটা বিষয় ক্লিয়ার করি। আমার ব্যাপারেও নানা জনে নানা কথা বলতো। ওতো নিজে নাটক বানায় না। এই অভিযোগটা কেন? একটা মেয়ে সংসারে সব কিছু করে। এটাই তো তার বড় ডিরেকশন। সন্তানের দেখভাল করা, শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়ি, সামাজিকতা সব কিছু সামাল দিয়ে তাকে চলতে হয়। সেই তো বড় ডিরেক্টর। পরিবারকে পরিচালনা করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। মেয়েরা সৌন্দর্য বুঝে বেশি। একটা বাড়ির সৌন্দর্য মেয়েদের হাতেই থাকে। সৌন্দর্য তৈরি হয় মেয়েদের হাতেই। কয়টা বাড়ির পুরুষ ভাবে বাড়ির ইনটেরিয়রটা এমন হবে, এমন হওয়া উচিৎ। মেয়েরাই ভাবে। অথচ মেয়েদেরকেই নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। এজন্য কী পুরুষ শাসিত সমাজ দায়ী? কোনো ডিসিশন নিতে গেলে পুরুষকে প্রায়োরিটি দেওয়া হয়। কারণ মেয়ে পারবে না। পুরুষ পারবে। এই মানসিকতা কেন? এটা বলে কী পুরুষেরা বড় হয়?
আমার নাটক নির্মাণ নিয়ে পিছন থেকে বলার অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। একটা মেয়ে এতো ভালো করবে কেন? অনেকে ঈর্ষা করতো। নিজের কথা একটু বলি। একটা ইয়াং মেয়ে। আমি যথেষ্ট সুন্দর এট্রাকটিভ ছিলাম। মানুষ সেটাও পছন্দ করতো না। ‘ও নিজের গাড়ি নিয়ে আসে…’ যখন আমি নিজের পয়সায় গাড়ি কিনলাম তখন একদিন আমাদের শাহাদাৎ ভাই (শাহাদাৎ চৌধুরী) বলেছিলেন, ফারিয়া তুমি তোমার শত্রু কিন্তু বাড়াইল্যা।
কেন, কেন একথা বলছেন? পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম শাহাদাৎ ভাইকে। তিনি বলেছিলেন, আগে বাপের গাড়িতে আসতা এখন নিজের টাকায় গাড়ি কিনেছো, তোমার কলিগদের বয়েই গেছে তোমাকে সহ্য করতে। একটা পুরুষকে নিয়ে তো এমন কথা হয় না। একটি মেয়েকে নিয়ে কেন কথা হবে? এর উত্তর আজ পর্যন্ত পাইনি।আনন্দ আলো: এবার একটু অন্য রকম প্রশ্ন। ফারিয়ার কাছে প্রশ্নÑ চয়নিকা চৌধুরী কেমন মানুষ?
ফারিয়া হোসেন: (একটু ভেবে নিয়ে) প্রথম দেখায় চয়নিকা চৌধুরীকে আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। কিন্তু ওর সঙ্গে মিশলেই বুঝতে পারবেন কতটা সহজ সরল মানুষ। হয়তো ভাববেন চয়নিকা বিরক্তিকর মানুষ। কারণ ও একটু ‘ঠ্যাটা’। যা মনে আসে হর হর করে বলে দেয়। ‘আমার ইন্টারভিউ নিবেন? যা যা বলবো তা লিখতে পারবেন? এই ধরনের সহজ কথা বলার মধ্যে সাহস লাগে। চয়নিকা সাহসী মেয়ে। সাহসী নারী। আমি রাইটার, চয়নিকা ডিরেক্টর। আমরা যৌথভাবে দুইশ প্লাস নাটক বানিয়ে ফেলেছি। আমরা যদি আর কোনো দিনই একসঙ্গে কাজ না করি তাহলেও সম্পর্ক নষ্ট হবে না। আমাদের মধ্যে একটা মানবিক, বন্ধুত্বপুর্ন সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। উই উইল বি কানেকটেড…
আরেকটা কথা বলি, চয়নিকা স্বার্থপর ভাবে তার কাজের প্রতি মায়া করে। ভালোবাসে। স্বার্থপর ভাবেই… ওর টিম ওয়ার্ক বেশ স্ট্রং।
আনন্দ আলো: এবার চয়নিকা চৌধুরীর কাছে প্রশ্ন, ফারিয়া হোসেন কেমন মানুষ?
চয়নিকা চৌধুরী: প্রথম কথা হল ক্রিয়েটিভিটির জায়গায় আমি ফারিয়ার অনেক বড় ভক্ত। আমার প্রিয় ডিরেক্টর সে। মূলত: তার কাছ থেকেই আমি নাটকের ব্যাপারে উৎসাহ পেয়েছি। তাকে দেখেই আমি ডিরেকশনে আসার সাহস করি। সে মানুষ হিসেবে কেমন এটা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ সে অসাধারন, মানবিক মানুষ। সে অনেক স্ট্রেট… তার মধ্যে অনেক মায়া। অনেকে বলে ফারিয়া এমন ফারিয়া তেমন। অথচ তার মধ্যে মানুষের জন্য অনেক মায়া। একটা কথা বলি। প্রত্যেকদিন সকালে ফারিয়ার ফোন যদি না আসে তখন আমার হাহাকার লাগে। মনে হয় কী যেন নাই। আমি বিপদে পড়লেই তিন, চারজন মানুষের নাম মনে পড়ে। তাদের মধ্যে একজন হল ফারিয়া। আমি জানি আমার বিপদের কথা শুনলে নামাজ শেষে ও আমার জন্য মুনাজাত করবে। আরেকটা কথা বলি। ফারিয়া আমাদের পরিবারের জন্য বিরাট একটা কাজ করেছে। এই কাজটা না করলে আমি এবং আমার মা-বাবা হেসে হেসে কথা বলার শক্তি পেতাম না।
আড্ডায় অনেক কথা হয় ফারিয়া ও চয়নিকার সঙ্গে। অন্য একদিন হয়তো সে কথা গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব। তবে তাদের বন্ধুত্বের বহি:প্রকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। দু’জনকেই একই প্রশ্ন করেছিলাম- আপনার দু’জন ভালো বন্ধু। বন্ধুত্ব টিকে থাকে কীসে?
চয়নিকা বললেন, বন্ধুত্ব টিকে থাকে বিশ্বাসে। পরস্পরকে বিশ্বাস করতে হবে। তোমার যখন প্রয়োজন তখন ফোন ধরল্যা। কিন্তু আমার প্রয়োজনে ফোন ধরল্যা না এটা করলে বন্ধুত্ব টিকে না। মায়া হলো বন্ধুত্বের প্রধান শক্তি। বিপদে হেল্প করতে না পারি পাশে তো থাকতে পারি। চিন্তা করিস না। আমি আছি তোর সঙ্গে… বন্ধুেেক এই কথাটা বললেই অনেক কথা বলা হয়।
ফারিয়া বললেন, প্রয়োজন বলে একটা কথা আছে। প্রয়োজনে আছি। প্রয়োজন নাই তো নাই… এভাবে বন্ধুত্ব টিকে না। বন্ধুত্ব সম্মান চায়। একটা ঘটনার কথা বলি। বিপাশা হায়াত একদিন তার পরিচিত এক ব্যক্তির সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলেছিল। ওর নাম ফারিয়া। অনেক ইমপোর্টেন্ট মানুষ…
সেদিন তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আমাকে এভাবে গুরুত্বপুর্ণ মানুষ বলার কী কোনো দরকার ছিল।
বিপাশা উত্তরে বলেছিল, হ্যা দরকার আছে। ভালো মানুষ আর ইমপোর্টেন্ট মানুষ এক কথা নয়। ভালো মানুষ অনেক সময় ইমপোর্টেন্ট এর তালিকায় পড়ে না।
তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে আরও অনেক কথা হয়েছে। সময় হলে আরেকদিন বলব।
আনন্দ আলোর পক্ষে অনেক শুভ কামনা ফারিয়া হোসেন ও চয়নিকা চৌধুরীর জন্য। তাদের বন্ধুত্ব আরও মজবুত হোক। আলো ছড়াক আমাদের মিডিয়া ভুবনে।
সম্পর্কিত