ঈদ হোক উৎসবের এবং অবশ্যই আনন্দের : আবুল হায়াত – আনন্দ আলো

ঈদ হোক উৎসবের এবং অবশ্যই আনন্দের : আবুল হায়াত – আনন্দ আলো

ঈদ উৎসব এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন বিশিষ্ট অভিনেতা, পরিচালক আবুল হায়াত। তাঁর সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ আনন্দ আলোর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হল।
শুরুতেই তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল- আপনার ছোটবেলায় ঈদ উৎসব কেমন ছিল? একটু যেন ভাবলেন আবুল হায়াত। তারপর বললেন, ঈদকে ঘিরে মূলত: একটা আনন্দ, উত্তেজনা দেখা দেয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেটা আর দেখি না। ঈদ উৎসব ডিজিটাল হয়ে গেছে। এখন ঈদকে ঘিরে সেই অর্থে কোনো উত্তেজনা দেখি না। আমাদের শৈশবে ঈদকে ঘিরে আমরা খুব উত্তেজিত থাকতাম। কোরবানীর ঈদের ব্যাপারটাই বলি। বাড়িতে কোরবানীর পশু আসবে। তার জন্য কী যে অপেক্ষা। কখন কোরবানীর পশু বাড়িতে আসবে? কখন আব্বার সঙ্গে পশুর হাটে যাব? কোরবানীর পশু কেনার পর সেটা যখন হাট থেকে বাড়িতে আনা হবে আমি তখন সবার সঙ্গে পশুটির পিছে পিছে হাটবো। বাড়িতে এনে তাকে ঘাস খাওয়ানো, ছাগল যদি হয় তাকে কাঁঠাল পাতা খাওয়ানো… রীতিমতো একটা উত্তেজনা তৈরি হতো। পশু জবাই করার পর কান্না থামাতে পারতাম না। কেন পশুটাকে জবাই করা হল? কত যে প্রশ্ন দেখা দিত?
ঈদে নতুন পোশাকের আনন্দ ছিল অন্যরকম। এখনকার মতো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে পোশাক পাওয়া যেত না। দর্জির কাছে ঈদের কাপড় বানাতে দিতে হতো। আমরা চট্টগ্রামে থাকতাম। ইকবাল নামে একজন বিহারী দর্জির কাছে বাবা পরিবারের সবার ঈদের নতুন জামা, প্যান্ট, সালোয়ার কামিজ, বেলাউজ বানাতে দিতেন। আব্বা মার্কেট থেকে কাপড় কিনে আমাদেরকে দর্জির কাছে নিয়ে যেতেন। দর্জি আমাদের শরীরে ফিতা টেনে কাপড়ের মাপ নিত। এরপর থেকে শুরু হতো বিরামহীন অপেক্ষা। মাঝে মাঝে দর্জির কাছে যেতাম। জিজ্ঞেস করতাম কাপড় সেলাই হয়েছে কিনা। দর্জি ব্যস্ততার সঙ্গে জবাব দিতÑ হবে, হবে… সময় হলেই হবে। কিন্তু সময় যে আর আসে না। এমনও হয়েছে ঈদের দিন সকালে দর্জি বাসায় ঈদের নতুন কাপড় দিয়ে গেছে। নতুন পোশাক পেয়ে সে কী উত্তেজনা দেখা দিতো। বালিশের নীচে লুকিয়ে রাখতাম। যাতে কেউ ঈদের নামাজের আগে দেখতে না পায়। কী যে সতর্ক থাকতাম।
ঈদের আগে ঈদের পোশাক দেখানোর যাবে না। ঈদের নতুন জুতা কেনার পর কতদিন যে আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছি তার হিসেব মেলানো যাবে না। নতুন জুতা। ঈদের আগে দেখানো যাবে না। ঈদকে ঘিরে এইযে উত্তেজনা সেটা বর্তমান প্রজন্মের কাছে দেখা যায় না। এজন্য সময়টাই দায়ী।
আগের দিনে নতুন জামা কাপড় বানানোর জন্য দর্জির কাছে যেতেই হতো। আর এখন দর্জির কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। যখন তখন মার্কেটে গিয়ে পছন্দের পোশাক সহ নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিস কেনা সম্ভব। পুরানো কাপড় পরে র্মাকেটে ঢুকে নতুন কাপড় পরে বেড়িয়ে আসা যায়। এতে তেমন উত্তেজনা থাকে না। এটাই সময়ের হিসেব। আগেকার দিনে প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে চিঠি ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। আর এখন মন চাইলেই যোগাযোগ করা যায়। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে থাকেন না ভিডিও কলে যখন তখন যোগাযোগ করা সম্ভব। ফলে প্রিয়জনের মধ্যে যোগাযোগ করার সেই আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। ভাবটা এমন আছি তো। যার প্রয়োজন সে যোগাযোগ করবে। আবার যোগাযোগ করলেও কথা সংক্ষিপ্ত বলেন অনেকে। কেমন আছেন? ভালো আছি? ব্যস কথা এটুকুই। যোগাযোগের রাস্তাটা সহজ হয়ে যাওয়ায় Abul--Hayat-1মানুষের মধ্যে প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। মানুষ অতিমাত্রায় যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। ভিডিও কলে বললাম- ঈদ মোবারক। ব্যস ঈদ উৎসব পালন করা হয়ে গেল। ঈদের নামাজ শেষে পরস্পরের মধ্যে আলিঙ্গণ অর্থাৎ কোলাকুলি করার নিয়মও এখন অনেকে মানে না। ঈদের নামাজ পড়েই দৌড় দেয় বাসার দিকে। কেউ দৌড়ায় কোরবানীর গরুর দিকে।
তার মানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কী ঈদের আনন্দকে ফিকে করে দিয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে আবুল হায়াত জোর দিয়েই বললেন, প্রযুক্তির যত উন্নতি হচ্ছে মানুষ ততই পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রয়োজন ছাড়া আমরা কারও সঙ্গে দেখা করি না। কথা বলি না। ঈদ মানেই উৎসব। আবার উৎসব মানেই আনন্দ। একা তো কখনও আনন্দ উৎসব করা যায় না। উৎসব হল সবাইকে নিয়ে করা…
আমি ফ্লাটবাড়িতে থাকি। কোরবানীর উদ্দেশে ৩০/৪০টা গরু হয়তো জবাই হবে। ঈদের একদিন আগে হয়তো গরু আনা হলো। পরের দিন জবাই করা হল। আমরা বসে বসে মাংস কাটা দেখলাম। তারপর বাসায় বাসায় মাংস গেল। কোরবানীর মাংসের ক্ষেত্রে অসহায় মানুষদের একটা হিস্যা আছে। ইদানিং শহর এলাকায় সেই ধরনের মানুষ পাওয়া যায় না। খোজ রাখি কোন আত্মীয় কোরবানী দেয় নাই। তার জন্য ফ্রিজে মাংস রেখে খবর দেই। অনেকে মাংস নিতেও আসে না। এই হচ্ছে প্রকৃত অবস্থা।
ঈদের নাটক বলতে একটা কথা প্রচলিত। ঈদের নাটক আমরা বানাই। ঈদের নাটক মানেই কী হাসির নাটক? এই প্রশ্নের জবাবে আবুল হায়াত বললেন, এটা নিয়ে একটা বিতর্ক ছিল এক সময়। আগে চেষ্টাই করা হতো, ঈদের নাটক মানেই হাসির নাটক। মানুষকে হাসানো। একটু আনন্দ দেওয়া। কিন্তু আনন্দ দেওয়ার নামে ভাড়ামো শুরু হওয়ায় ঈদের নাটকের সেই সজ্ঞা পাল্টে গেছে। ঈদে এখন দর্শক সেই অর্থে হাসির নাটক চায় না। ভালো নাটক চায়। যে নাটক দেখে মানুষ তার নিজেকে খুঁজে পায় সেটাই মূলত: ভালো নাটক।
প্রতি ঈদে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে আড়াইশ থেকে তিনশ নাটক প্রচার হয়। কয়টা ভালো নাটক? প্রশ্ন শুনে আবুল হায়াত বললেন, এব্যাপারেও নানান বিতর্ক আছে। কিন্তু আমি মনে করি ইদানিং তরুণ নির্মাতারা অনেক ভালো টিভি নাটক বানাচ্ছেন। প্রযুক্তিগত উন্নতি হয়েছে। তবে অনেক নাটকের ভীড়ে ভালো নাটক অনেকের চোখে পড়ে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভালো নাটকই আলোচিত হয়। প্রশংসিত হয়। আমাদের অনেক ভালো আর্টিস্ট আছেন। ভালো টেকনিশিয়ান তৈরি হয়েছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কাজেই দুশ্চিন্তার কারণ নাই। এখন হল মেধাবীদের যুগ। কাজেই মেধাবীরাই টিকে থাকবে। ভালো নাটকই মানুষ খুঁজবে। ইউটিউবে কিন্তু ভালো নাটকের প্রতিই মানুষের আগ্রহ বেশি।
নাটকের ভিউ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে… প্রশ্নটা শেষ করতে দিলেন না আবুল হায়াত। বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, আমি ভিউ শব্দটাকেই পছন্দ করি না। এই ধরনের নাটকের ভিউ আছে। অনেকে এক নাটক দশবার দেখে। কিন্তু দেখার পর সব ভুলে যায়।
অনেক টিভি চ্যানেল তো ভিউ বাড়বে এমন নাটক চায়? প্রশ্নের জবাবে আবুল হায়াত বললেন, অনেক নয় সব টিভি চ্যানেলই ভিউ বাড়বে এমন নাটক চায়। ভিউ এর উপরেই আর্টিস্ট সিলেকশন করে। এই ব্যাপারটা আমার মোটেও পছন্দ নয়। এটা এক ধরনের আত্মঘাতি মানসিকতা। আজ হয়তো আমরা বুঝতে পারছি না। একদিন ঠিকই বুঝতে পারবো। তখন হয়তো ফিরে আসার পথ খুঁজে পাব না। ‘ভিউ’ মানসিকতার কারণে অভিনয় জগতে প্রকৃত অভিনেতা, অভিনেত্রীরা কাজ পাচ্ছেন না। এটা দুঃখজনক।
কথায় কথায় অনেক কথাই আলোচিত হল। শিল্পীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রশ্ন তুলতেই আবুল হায়াত বললেন, প্রতিটা মানুষেরই রাজনীতি করার অধিকার আছে। একজন শিল্পী সেও তো একজন মানুষ। রাজনীতি করার অধিকার তার আছে। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে সে কতটুকু জড়িত হবে তার একটা লিমিটেশন থাকা দরকার। আমার পছন্দের একটি দল থাকতেই পারে। আমি সেই দলের কথা বলতে গিয়ে আমার পেশাকে কতটা প্রশ্নবিদ্ধ করছি তা ভাবা জরুরি। রাজনীতি করতে গিয়ে নিজের পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ঠিক নয়। আপনি যদি রাজনীতি করতেই চান তাহলে ফুল টাইম রাজনীতিই করুন। নিজের শিল্পী স্বত্বাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না।
সাম্প্রতিক সময়ে একজন চিত্রনায়িকাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে একটি সিনেমায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন… প্রশ্নটা শেষ করতে দিলেন না আবুল হায়াত। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, এটাই কী তার বিরুদ্ধে প্রকৃত অভিযোগ ছিল? বিষয়টা পরিস্কার হয়নি। একজন জনপ্রিয় শিল্পীকে হত্যামামলার আসামী বানানো হল। ৩/৪’শ আসামীর নামের সঙ্গে একজন জনপ্রিয় শিল্পীর নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হল। সে আসামী হয়ে গেল? এটা ন্যাক্কারজনক ভাবনা। সমাজে শিল্পীদের আলাদা একটা মর্যাদা আছে। কথায় কথায় শিল্পীদের হেয় করা ঠিক নয়।
কথা উঠেছে বর্তমানে কোনো কোনো শিল্পীকে যে দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করা হচ্ছে, বিপদে ফেলা হচ্ছে… তাতে ভবিষ্যতে কোনো শিল্পী কোনো রাজনৈতিক নেতার বায়োপিকে অভিনয় করতে রাজি হবে না। আপনার কী মনে হয়?
উত্তরে আবুল হায়াত বললেন, কেউ অভিনয় করবে নাতো। কেন করবে? আমি শেখ মুজিবের চরিত্রে যদি অভিনয় করি তাহলে কী আমি শেখ মুজিব হয়ে যাব? এটা সম্ভব? এটা আমার প্রফেশন। আমি যে কারও চরিত্রে অভিনয় করতেই পারি। আমি যদি রাজাকারের চরিত্রে অভিনয় করি তাহলে কী আমি রাজাকার? আমিতো একজন অভিনেতা। অভিনয়ের ক্ষেত্রে শিল্পীর স্বাধীনতাটা জরুরি।



Scroll to Top