এ জেড এম আব্দুস সবুর
ঈদে মিলাদুন্নবী হচ্ছে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ উৎসবমুখর দিন। সারা বিশ্বের বহু মুসলিম অত্যন্ত জাঁকজমক, ভক্তি ও মর্যাদার সাথে আরবী বৎসরের ৩য় মাস রবিউল আউআল মাসের ১২ তারিখে এই ঈদে মিলাদুন্নবী বা নবীর জন্মের ঈদ পালন করেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমই এই ‘ঈদের’ উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাসের সাথে পরিচিত নন। যে সকল ব্যক্তিত্ব এই উৎসব মুসলিম উম্মার মধ্যে প্রচলন করেছিলেন তাদের পরিচয়ও আমাদের অধিকাংশের অজানা রয়েছে। নবীজির জীবদ্দশায় এ ধরনের উৎসবের আয়োজন করা না হলেও তার মৃত্যুর কয়েকশ বছর পর প্রথমবারের মতো উদযাপন করা হয় ঈদে মিলাদুন্নবী। ইসলামি পণ্ডিতদের মাঝে অনেক বিতর্ক থাকলেও কালক্রমে এই উৎসবটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ঈদে মিলাদুন্নবীর ইতিহাস
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর প্রথম যুগে সাহাবি, তাবেয়ি ও তাবে তাবেয়িদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিন পালন বা উদযাপন করার প্রচলন ছিল না। মুহাদ্দিস, ফিকহ ও ঐতিহাসিকদের গবেষণায় এই মত দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) জন্মদিন পালন বা রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের বৈধতা ও অবৈধতা নিয়ে আলেম সমাজে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। তবে মিলাদুন্নবী উদযাপনের পক্ষের ও বিপক্ষের সব আলেম ও গবেষক একমত যে, ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলোতে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করার কোনো প্রচলন ছিল না।
নবম হিজরি শতকের অন্যতম আলেম ও ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে হাজর আল-আসকালানি (মৃত্যু ১৪৪৯ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন, ‘মাওলিদ (ঈদে মিলাদুন্নবী) পালন মূলত বিদ’আত। ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন শতাব্দীর সালফে সালেহিনদের মধ্যে কোনো একজনও এই কাজ করেননি।’
হিজরি নবম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে প্রখ্যাত মুদাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা আবুল খাইর মুহাম্মাদ ইবন আব্দুর রহমান আস-সাখাবি (মৃত্যু: ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন, ‘ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন যুগের সালফে সালেহিনদের (সাহাবি, তাবেয়ি ও তাবে-তাবেয়ি) মধ্যে কোনো একজনকেও মাওলিদ পালনের কোনো ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায় না। মাওলিদ পালন বা উদযাপন পরবর্তী যুগে উদ্ভাবিত হয়েছে। এরপর থেকে সব দেশের ও সব বড় বড় শহরের মুসলিমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম দিন ও মাস পালন করে আসছেন। এ উপলক্ষে তারা অত্যন্ত সুন্দর জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবময় খানাপিনার মাহফিলের আয়োজন করেন। এ মাসের রাতগুলোতে তারা নানা রকমের দান সদকা করেন, আনন্দ প্রকাশ করেন এবং জনকল্যাণমূলক কর্ম বেশি করে করেন। এ সময় তারা নবীজীর জন্মকাহিনী পাঠ করতে মনোনিবেশ করেন।’
লাহোরের প্রখ্যাত আলেম সাইয়েদ দিলদার আলি (মৃত্যু ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ) মিলাদের সপক্ষে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘মিলাদের কোনো সূত্র প্রথম তিন যুগের সালফে সালেহিন থেকে বর্ণিত হয়নি। বরং তাদের যুগের পর এর উদ্ভাবন হয়েছে।’
আলেমদের এই ঐকমত্যের সূত্র হলো দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে সংকলিত অর্ধশতাধিক সনদভিত্তিক হাদিসের গ্রন্থ। এসব গ্রন্থে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্ম, আচার-আচরণ, কথা, অনুমোদন, আকৃতি, প্রকৃতি ইত্যাদি সংকলিত হয়েছে। সংকলিত হয়েছে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়িদের মতামত ও কর্ম। সেসব গ্রন্থের একটি হাদিসেও দেখা যায় না যে, রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় বা তার মৃত্যুর পর কোনো সাহাবি সামাজিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে তার জন্ম উদযাপন, জন্মদিন নিয়ে আলোচনা বা জন্ম উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন বা অনির্দিষ্টভাবে বৎসরের কোনো সময়ে কোনো অনুষ্ঠান করেছেন।
একমাত্র রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন তাদের আলোচনা, সব চিন্তা-চেতনার প্রাণ, সব কর্মকাণ্ডের মূল। তারা নবীজির জীবনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনা আলোচনা করে তার ভালোবাসায় চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন। তার আকৃতি, প্রকৃতি ও পোশাক-আশাকের কথা বর্ণনা করে জীবন অতিবাহিত করেছেন। কিন্তু তারা কখনো তার জন্মদিন পালন করেননি। এমনকি তার জন্ম মুহূর্তের ঘটনাবলি আলোচনার জন্যও তারা কখনো বসেননি বা জন্ম উপলক্ষে কোনো দান সদকা কিংবা আনন্দ উৎসবের আয়োজন করেননি। তাদের পর তাবেয়ি ও তাবে তাবেয়িদের অবস্থাও একই ছিল।
বস্তুত, কারও জন্ম বা মৃত্যুদিন পালন করার বিষয়টি আরবের মানুষের কাছে একেবারেই অজ্ঞাত ছিল। জন্মদিন পালন অনারবীয় সংস্কৃতির অংশ। এর মধ্যে পারস্যের মাজুস (অগ্নি উপাসক) ও বাইজেন্টাইন খ্রিস্টানদের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল জন্ম কিংবা মৃত্যুদিন পালন করার মতো বিষয়গুলো। হিজরি তৃতীয় শতাব্দী থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যে অনারব পারসিয়ান ও তুর্কি মুসলিমদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যে নতুন নতুন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতির প্রচলন ঘটে। এসব রীতিনীতির মধ্যে ঈদে মিলাদুন্নবী ছিল অন্যতম।
লেখক: আইনজীবী
সারাবাংলা/এসবিডিই