চলতি মাসের শুরুতে ইসরায়েলে তেহরানের হামলার জবাব দিতে ইরানের ‘নির্দিষ্ট সামরিক লক্ষ্যে’ বিমান হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েলের সামারিক বাহিনী। শনিবার (২৬ অক্টোবর) ভোরে এই হামলা চালানো হয়। তবে ইসরায়েলি হামলা প্রতিহত করার কথা জানিয়েছে ইরান। দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী ইসরায়েলি ড্রোনগুলো আকাশেই ধ্বংস করার দাবি করেছে।
ইরান ও ইসরায়েলের বিরোধ পুরোনো। ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক শক্তির বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক লেখক ও বিশ্লেষক আলি সদরজাদেহ বলেছেন, সামরিক সক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইসরায়েলের সঙ্গে বড় ধরনের সংঘাতে যাওয়ার সামর্থ্য ইরানের নেই।
যুক্তরাজ্যের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) অনুসারে ইরানের বিমান বাহিনীর সদস্য ৩৭ হাজার। কিন্তু কয়েক দশকের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান সর্বাধুনিক উচ্চ প্রযুক্তির সামরিক সরঞ্জাম থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
দেশটির বিমান বাহিনীর কাছে মাত্র কয়েক ডজন কর্মক্ষম যুদ্ধবিমান রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে রাশিয়ান জেট এবং ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের আগে অর্জিত মার্কিন মডেলগুলো।
আইআইএসএস জানিয়েছে, ইরানের কাছে নয়টি করে এফ-৪, এফ-৫ যুদ্ধবিমান রয়েছে। এছাড়া রাশিয়ার তৈরি সুখোই-২৪ এবং কিছু মিগ-২৯, এফ-৭ এবং এফ-১৪ যুদ্ধবিমান রয়েছে।
ইরানেও পাইলটবিহীন বিমান রয়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, ইরানের কাছে সাড়ে ৩ হাজার ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটি অর্ধ টন ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। তবে ইসরায়েলের মাটিতে পৌঁছতে সক্ষম এমন ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কম ।
গত এপ্রিলে ইরানের বিমান বাহিনীর কমান্ডার বলেছিলেন, রাশিয়ার তৈরি সুখোই-২৪ দিয়ে যেকোন সম্ভাব্য ইসরায়েলি আক্রমণ মোকাবিলায় তারা প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু ১৯৬০ -এর দশকে প্রথম বিকশিত সুখোই-২৪-এর ওপর ইরানের নির্ভরতা তার বিমান বাহিনীর দুর্বলতাকে তুলে ধরে, বলেন সামরিক বিশ্লেষকরা।
ইরান ২০১৬ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৩০০ কিনেছিল। তেহরান নিজেরা তৈরি করেছিল বাভার-৩৭৩ এর পাশাপাশি সাইয়্যাদ এবং রাদ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
এদিকে ইসরায়েলের কাছে উন্নতমানের মার্কিন সরবরাহকৃত যুদ্ধবিমান রয়েছে। তাদের শত শত এফ-৫, এফ-১৫, এফ-১৬ এবং এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান রয়েছে। তবে ইসরায়েলের বিমান বাহিনীর কাছে দূরপাল্লার বোমারু বিমানের সংখ্যা তুলনামূলক ইরানের চেয়ে কম।
যদিও ইসরায়েলি বিমান বাহিনী গত জুলাই মাসে ইয়েমেনের হোদেইদাহ বন্দরের কাছাকাছি এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে দূরপাল্লার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার সক্ষমতা দেখিয়েছিল।
ড্রোন প্রযুক্তিতে অগ্রগামী ইসরায়েলের কাছে পাইলটবিহীন হেরন রয়েছে, যা ৩০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে উড়তে সক্ষম।
ইসরায়েল ব্যাপকভাবে ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে বলে মনে করা হয়। তবে এটা নিশ্চিত করা যায়নি।
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পরে মার্কিন সহায়তায় একটি বহু-স্তরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে ইসরায়েল। যা দূর-পাল্লার ইরানি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার সক্ষমতা রয়েছে।
ইসরায়েলের বিমানবাহিনীর কাছে ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী অ্যারো-৩ ইন্টারসেপ্টর ব্যবস্থা রয়েছে। যা আকাশেই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে সক্ষম।
গ্লোবাল ফায়ার আর্মসের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, ইরানের সামরিক বাহিনীতে সক্রিয় সেনা আছে ৬ লাখ ১০ হাজার, যা বিশ্বের অষ্টম শীর্ষ লোকবল। বিপরীতে ইসরায়েলের আছে মাত্র ১ লাখ ৭০ হাজার সেনা। তবে ইরানের রিজার্ভ বাহিনীতে সেনাসংখ্যা ৩ লাখ ৫০ হাজার হলেও ইসরায়েলের এই সংখ্যা ৪ লাখ ৬৫ হাজার।
ইরানের আধাসামরিক বাহিনীর আকার যথেষ্ট বড়। দেশটির আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা যেখানে ২ লাখ ২০ হাজার, সেখানে ইসরায়েলের মাত্র ৩৫ হাজার আধাসামরিক সেনা আছে। সেনাসংখ্যা বেশি হলেও ইসরায়েলের চেয়ে ইরানের সামরিক বাজেট কম। ইরান যেখানে সর্বশেষ প্রতিরক্ষা খাতে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে, সেখানে ইসরায়েল দিয়েছে ২৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
ইরানের যেখানে মোট ৫৫১টি বিমান আছে, সেখানে ইসরায়েলের আছে মোট ৬১২টি বিমান। এছাড়া, ইরানের যুদ্ধবিমান আছে ১৮৬ এবং ইসরায়েলের আছে ২৪৬টি। তবে সেনা ও রসদ পরিবহন সক্ষমতায় ইরান এগিয়ে। তেহরান যেখানে ৮৬টি ট্রান্সপোর্ট বিমানের মালিক সেখানে ইসরায়েলের আছে মাত্র ১২টি।
আকাশ সক্ষমতায় ইরানের চেয়ে ইসরায়েল যে এগিয়ে তার আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় দুই দেশের হেলিকপ্টারের সংখ্যার তুলনা থেকে। ইরানের ১২৯টি সাধারণ হেলিকপ্টার ও ১৩টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার আছে। বিপরীতে ইসরায়েলের ১৪৬টি সাধারণ হেলিকপ্টার ও ৪৮টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার আছে।
স্থল আক্রমণের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের চেয়ে ইরান তুলনামূলক এগিয়ে। ইরানের ট্যাংক আছে ১ হাজার ৯৯৬টি এবং ইসরায়েলের আছে ১ হাজার ৩৭০টি। ইরানের সাঁজোয়া যান যেখানে ৬৫ হাজার ৭৬৫টি, সেখানে ইসরায়েলে এ ধরনের যান আছে ৪৩ হাজার ৪০৭টি।
গোলন্দাজ বা আর্টিলারি ইউনিটের ক্ষেত্রে ইসরায়েল-ইরানের শক্তিমত্তা প্রায় কাছাকাছি। ইরানের সেলফ প্রপেলড আর্টিলারি ইউনিট আছে ৫৮০টি এবং ইসরায়েলের আছে ৬৫০টি। ইরানের টোয়েড আর্টিলারি আছে ২০৫০টি এবং ইসরায়েলের আছে মাত্র ৩০০টি। আবার ইরানের মোবাইল রকেট প্রজেক্টর আছে ৭৭৫টি, বিপরীতে ইসরায়েলের আছে মাত্র ১৫০টি। সার্বিক বিবেচনায় এই খাতে ইরান এগিয়ে আছে।
ইসরায়েলে ইরানি হামলা কি অবশ্যম্ভাবী, নাকি ফায়দা হাসিলে মনস্তাত্ত্বিক চাপইসরায়েলে ইরানি হামলা কি অবশ্যম্ভাবী, নাকি ফায়দা হাসিলে মনস্তাত্ত্বিক চাপ নৌশক্তির দিক থেকেও ইরান ইসরায়েলের চেয়ে এগিয়ে। ইরানের সামগ্রিকভাবে যুদ্ধসংক্রান্ত নৌযান আছে ১০১টি, বিপরীতে ইসরায়েলের আছে মাত্র ৬৭টি। দুই দেশের কারওরই বিমানবাহী রণতরি নেই। তবে সাবমেরিনের ক্ষেত্রে ইরান এগিয়ে। দেশটির ১৯ সাবমেরিনের বিপরীতে ইসরায়েলের আছে মাত্র ৫টি।
ইরান বা ইসরায়েল কোনো দেশরই ডেস্ট্রয়ার নেই। তবে ইরানের ফ্রিগেট ৭টি, ইসরায়েলের নেই একটিও। তবে ইরানের করভেট যেখানে মাত্র ৩টি, সেখানে ইসরায়েলের আছে ৭টি। পেট্রল ভেসেলের ক্ষেত্রেও এগিয়ে ইসরায়েল। দেশটির ৪৫ নৌযানের বিপরীতে ইরানের আছে মাত্র ২১টি। তবে ইসরায়েলের কোনো মাইন ওয়ারফেয়ার শিপ না থাকলেও ইরানের আছে একটি।