ইরানের নতুন পদক্ষেপ: জিপিএস ছেড়ে উপগ্রহ বেইদু

ইরানের নতুন পদক্ষেপ: জিপিএস ছেড়ে উপগ্রহ বেইদু

এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ

সম্প্রতি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক সংঘাতে প্রযুক্তির নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে। এই সংঘাতকালে জিপিএস সংকেতে বারবার বিঘ্ন ঘটায় ইরান বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধানে নেমেছে। জিপিএসের পরিবর্তে চীনের ‘বেইদু’ নামক উপগ্রহ ব্যবস্থা ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে দেশটি।

আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ মনে হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে এক নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই মনোভাবই ইউরোপের গ্যালিলিও থেকে রাশিয়ার গ্লোনাস পর্যন্ত জাতীয় বা আঞ্চলিক উপগ্রহ দিকনির্দেশনা ব্যবস্থা তৈরির অন্যতম চালিকা শক্তি। প্রতিটি ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী অবস্থান নির্ণয়ের বাজারে নিজেদের অংশীদারিত্ব চাইছে এবং সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণের নিশ্চয়তা দিচ্ছে।

ইরান এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য এর প্রভাব স্পষ্ট: পশ্চিমা প্ল্যাটফর্মগুলোকে আর কেবল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিশ্বাস করা যায় না; সেগুলোকে এখন একটি বৃহত্তর ডিজিটাল গুপ্তচর যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইরানের যোগাযোগবিষয়ক উপমন্ত্রী ইহসান চিতসাজ জানিয়েছেন, ইরান পরিবহন, কৃষি ও ইন্টারনেট ব্যবস্থায় বেইদু উপগ্রহ ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

বহু দশক ধরে পশ্চিমারা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বের প্রযুক্তিগত অবকাঠামোতে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম, ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগ এবং উপগ্রহ নেটওয়ার্ক – সবকিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে বিশ্বের অনেক দেশই এমন একটি অবকাঠামোর উপর নির্ভরশীল, যা তারা নিজেরা তৈরি করতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই নির্ভরতা সহজেই দুর্বলতায় পরিণত হতে পারে। ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন তথ্য ফাঁসের ঘটনায় দেখা গেছে, কীভাবে পশ্চিমা প্রযুক্তিগুলো বিশ্বব্যাপী নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহে ব্যবহৃত হয়েছে, যা বিভিন্ন দেশকে চিন্তিত করেছে।

মানুষদের ট্র্যাক করার জন্য বেইদু ব্যবহার করছে চীন

ইরানের বেইদু গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত অন্য দেশগুলোর জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা নিয়ে এসেছে, যারা প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং কৌশলগত আত্মরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামোর ওপর অন্ধ এবং সরল নির্ভরতার যুগ দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। দেশগুলো আর এমন একটি পরাশক্তির উপগ্রহ ব্যবস্থার উপর তাদের সামরিক সক্ষমতা এবং ডিজিটাল সার্বভৌমত্বকে বেঁধে রাখতে পারে না, যাদের ওপর তারা পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছে না।

যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল হামলায় ইরান শুধু জিপিএসের দুর্বলতাই দেখেনি, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বেশ কয়েকজন ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল। ইসরায়েল কীভাবে তাদের সঠিক অবস্থান জানতে পারল, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয় যে, তারা টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রবেশ করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লোকেদের অবস্থান জানতে পেরেছিল।

সংঘাত চলার সময় ১৭ জুন ইরানি কর্তৃপক্ষ ইরানি জনগণকে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার বন্ধ করতে এবং তাদের ফোন থেকে এটি মুছে ফেলার আহ্বান জানায়, কারণ এটি ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে ইসরায়েলে পাঠাচ্ছে। এই আপিলের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ডের কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের মেটা-পরিচালিত এই অ্যাপ সম্পর্কে ইরানের অবিশ্বাস অমূলক নয়। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে অ্যাপটির নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছেন। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্যবস্তু করতে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার ব্যবহার করে, তা নাকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য থেকে নেওয়া হয়। উপরন্তু, ইরানের ওপর হামলা শেষ হওয়ার পরপরই মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ সরকারি যন্ত্র থেকে হোয়াটসঅ্যাপ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করে।

তেহরান ইতিমধ্যে নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা, জাতীয় তথ্য নেটওয়ার্ক তৈরি করছে, যা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ দেবে। ভবিষ্যতে, ইরান সম্ভবত এই প্রক্রিয়া আরও প্রসারিত করবে এবং চীনের ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’ অনুকরণ করার চেষ্টা করবে।
পশ্চিমা-নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করে তেহরান পশ্চিমা আধিপত্যকে মৌলিকভাবে চ্যালেঞ্জ করে এমন একটি ক্রমবর্ধমান প্রভাব বলয়ের সঙ্গে নিজেদেরকে দৃঢ়ভাবে যুক্ত করছে। এই অংশীদারিত্ব শুধু বাণিজ্যিক আদান-প্রদানকে ছাড়িয়ে যায়, কারণ চীন ইরানকে প্রকৃত ডিজিটাল ও কৌশলগত স্বাধীনতার জন্য অপরিহার্য সরঞ্জাম সরবরাহ করছে।

এর বৃহত্তর প্রেক্ষাপট হলো চীনের বিশাল ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’। যদিও এটিকে প্রায়শই একটি অবকাঠামো এবং বাণিজ্য প্রকল্প হিসেবে তুলে ধরা হয়, তবে এর উদ্দেশ্য শুধু রাস্তা এবং বন্দরের চেয়েও অনেক বেশি। এটি একটি বিকল্প বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি মূল জ্বালানি সরবরাহকারী দেশ হিসাবে ইরান এই বিশাল দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠছে।

আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি তা হলো একটি নতুন শক্তিশালী প্রযুক্তিগত জোটের উত্থান – যা ডিজিটাল অবকাঠামোকে রাজনৈতিক প্রতিরোধের এক ভাগ করে তুলছে। পশ্চিমা দেশগুলির দ্বিমুখী নীতি, একতরফা নিষেধাজ্ঞা এবং অপ্রতিরোধ্য ডিজিটাল আধিপত্যে ক্লান্ত দেশগুলি বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মধ্যে স্বস্তি এবং উল্লেখযোগ্য সুবিধা খুঁজে পাবে।

এই দ্রুত পরিবর্তন একটি নতুন ‘প্রযুক্তিগত স্নায়ুযুদ্ধ’-এর সূচনা করছে, যেখানে দেশগুলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো – দিকনির্দেশনা এবং যোগাযোগ থেকে শুরু করে তথ্য প্রবাহ এবং আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা পর্যন্ত – প্রাথমিকভাবে প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব বা ব্যাপক বিশ্বব্যাপী বিস্তারের উপর ভিত্তি করে নয়, বরং রাজনৈতিক আনুগত্য এবং অনুভূত নিরাপত্তার উপর ভিত্তি করে বেছে নেবে।

যত বেশি দেশ এই পথ অনুসরণ করবে, পশ্চিমা প্রযুক্তিগত সুবিধা বাস্তব সময়ে সংকুচিত হতে শুরু করবে, যার ফলস্বরূপ আন্তর্জাতিক ক্ষমতার গতিশীলতা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হবে।

Scroll to Top