আল হাবিব, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৫০
সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জ ২৫০ শষ্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতাল যেন এক অনিয়ম ও দুর্নীতির ‘স্বর্গরাজ্য’। ২০২২-২৩ অর্থ বছরের অডিট প্রতিবেদন এবং সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্মারকলিপি এবং হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট একাধিক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে ‘পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি’ হচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক শিক্ষার্থী নাহাত হাসান পৌলমি বললেন, সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে সিন্ডিকেটের একজন হচ্ছেন সুলতান সুলেমান। যাকে আলাদিনের দৈত্য বলা হয়। এই বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য মূলত স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। এই সিন্ডিকেটের আরও যারা আছেন তদন্ত করে বের করা এবং এমন লুটপাট ঠেকানোও জরুরি মনে করছি আমরা।
হাসপাতালের অডিট প্রতিবেদনে দেখা যায়, জেলা সদর হাসপাতালে একটি ব্লাড সেল কাউন্ট অটোমেশন ল্যাব এবং ফুল অটোমেশন ল্যাব ক্লিনিক্যাল ক্যামেস্ট্রি এনালাইজার কেনা হয়েছিল ২০১৮ সালে। এই দুটো যন্ত্র অব্যবহৃত অবস্থায় আছে। যন্ত্রগুলো অপারেট করার জন্য বিশেষজ্ঞ টেকনোলজিস্ট না থাকায় এবং যন্ত্র নষ্ট থাকায় ব্যবহার হচ্ছে না। প্যাথলজি বিভাগে এই যন্ত্রগুলো সরবরাহ করা হয়নি। কিন্তু এই মেশিনের জন্য সরবরাহকারীর যোগসাজসে চার কোটি ৭৫ লাখ ৩৫ হাজার ৯০ টাকার রাসায়নিক কেনা হয়েছে।
অডিট রিপোর্ট, ছাত্রদের স্মারকলিপি ও অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু এই যন্ত্র নিয়ে দুর্নীতি নয়, হাসপাতালের ১৯টি কম্পিউটারের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ ক্রয় ও মেরামত দেখিয়ে প্রায় ২৪ লাখ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে।
নিরীক্ষক দল যাচাই শেষে রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন, হাসপাতালে ডেক্সটপ ১৯টি এবং ল্যাপটপ তিনটি পাওয়া গেছে। এই কম্পিউটার সমূহ মেরামতের জন্য ৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এরপরে আবার কম্পিউটার সামগ্রীর ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ ক্রয় বাবদ বিভিন্ন ভাউচারের মাধ্যমে ২৩ লাখ ৫০ হাজার ২১৯ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। নিরীক্ষক দল তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন ওই ভাউচারগুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নয়। এছাড়া পুরাতন যন্ত্রাংশও সংরক্ষণ করা হয়নি।
এছাড়া এমএসআর যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে সর্বনিম্ন দরদাতাকে না দিয়ে উচ্চ দরদাতাকে কার্যাদেশ দিয়ে ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার ৪৭৬ টাকা নয়-ছয় হয়েছে।
নিরীক্ষা কমিটি উল্লেখ করেছেন, এমএসআর (যন্ত্রপাতি) গ্রুপ ‘খ’ সরবরাহের জন্য ১২ জন দরপত্রদাতা দরপত্র দাখিল করে। এরমধ্যে পাঁচটি দরপত্র গ্রহণ করা হয়। সাতটি বাতিল করা হয়। ১২ জন দরপত্র দাতার সিডিউল পর্যালোচনা করে দেখা যায়—সিডিউলে দাখিলকৃত ৫৮টি আইটেমের মধ্যে ৪৮টি আইটেমের দাখিলকৃত দর অনুযায়ী মেসার্স ইউরো ট্রেডিং কোম্পানী সর্বনিম্ন। দাখিলকৃত সিডিউলের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে উচ্চ দরদাতা ফরচুন করপোরেশনকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার ৪৭৬ টাকা।
এছাড়া দরপত্রে উল্লেখিত সার্জিক্যাল ব্যান্ডেজের স্থলে কম দৈর্ঘের সার্জিক্যাল ব্যান্ডেজ গ্রহণ করে এক বছরে আট লাখ ৭৪ হাজার ৮০০ টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। ক্যামিক্যাল ‘রি’ এজেন্ট ক্রয়েও ৯ লাখ ৫৭ হাজার ১০০ টাকা বেশি দেওয়া হয়েছে এক বছরে।
নিরীক্ষাকালে অডিট দল দেখতে পান দাখিলকৃত সিডিউলে সর্বনিম্ন দরদাতা ইউরো ট্রেডিং কোম্পানীকে না দিতে দাখিলকৃত সিডিউলের ১১, ১৩, ১৮, ২০ ও ২৩ নম্বর পাতা ছিঁড়ে অনিয়মের আশ্রয়ে ফরচুন কর্পোরেশনকে দিয়ে ৯ লাখ ৫৭ হাজার ১০০ টাকার আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। আরও কিছু এমএসআর সামগ্রী ক্রয়ে বাজার মূল্যের চেয়ে ২৭ লাখ ৮৮ হাজার ৪১৬ টাকা বেশি লাগানো হয়েছে।
নিরীক্ষা দল কতৃর্ক সরাসরি খোলা বাজার হতে ভাউচারের মাধ্যমে সংগ্রহ করে ভ্যাট, আইটি এবং লভ্যাংশ এবং পরিবহন ব্যায় বাবদ ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত মূল্য যোগ করার পরেও ২৭ লাখ ৮৮ হাজার ৪১৬ টাকা বেশি দেওয়া হয়েছে দেখতে পেয়েছেন।
হাসপাতালের কিছু যন্ত্রপাতির ওয়ারেন্টির মেয়াদ এক বছর থাকার পরেও পুনরায় মেরামত বাবদ ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এরকম অনিয়ম করে ১৮ লাখ ৭৯ হাজার ৯০০ টাকা তছরুপ করা হয়েছে।
অনাবাসিক ভবনের বর্জ্য সংরক্ষণাগার এবং অফিস সরঞ্জাম মেরামত না করেই মেরামত বাবদ ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ২৫০ টাকা বিল উত্তোলন হয়েছে। নিরীক্ষক দল রিপোর্টে তা উল্লেখ করেছেন।
নিরীক্ষক দলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, অনাবাসিক ভবনের বর্জ্য সংরক্ষণাগার এক বছরে তিনবার মেরামত করা হয়েছে। প্রতিবার মেরামতের জন্য তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ৪৫ বার ইউপিএস, ৩৫ বার প্রিন্টার, ৩৬ বার পানির ফিল্টার মেরামত করা দেখানো হয়। যে কারো কাছেই অস্বাভাবিক ঠেকবে এমন বিষয়। এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণও হাসপাতালে পাওয়া যায়নি।
সরবরাহকারীর বিল হতে আয়কর কর্তন না করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ১৪ লাখ ৬২ হাজার ৩৩৫ টাকা। ২০২২—২০২৩ অর্থ বছরের জন্য প্রযোজ্য আয়কর কোন বিল হতেই কর্তন করা হয়নি। পরিশোধিত সব বিলের আয়কর বাবদ কর্তন করার কথা ৬৭ লাখ ২৯ হাজার ৮৬২ টাকা। কিন্তু আয়কর কর্তন করা হয়েছে ৫২ লাখ ৬৭ হাজার ৫২৭ টাকা। অর্থাৎ ১৪ লাখ ৬২ হাজার ৩৩৫ টাকা সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করা হয়েছে। এই অর্থ বছরের হাসপাতালের কেবিন ভাড়া থেকে প্রাপ্য টাকার ২১ লাখ ৯৬ হাজার ৯৭৫ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা করা হয়নি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই এক বছরে ৮৮৭ জন রোগী চার হাজার ৩১৭ দিন ফ্রি অবস্থান করেছেন দেখালেও এর স্বপক্ষে যুক্তিসঙ্গত কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি বা প্রমাণও দিতে পারেনি। ওই এক বছরে আসবাবপত্র মেরামত না করেই ১৫ লাখ টাকা আসবাবপত্র মেরামত খরচ দেখানো হয়েছে।
নিরীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে বাস্তবে যাচাই করে দেখা গেছে, হাসপাতালে কোন আসবাবপত্র মেরামত করা হয়নি। মেরামতের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণও দেখাতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
নিরীক্ষাকালে দেখা গেছে, মেসার্স সামিয়া এন্টারপ্রাইজ নামের ওই ঠিকাদারকে সরঞ্জামাদি মেরামত দেখিয়ে ২০২১—২০২২ সালে ৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকার ভুয়া বিল প্রদান করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কতৃর্ক সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্ট করার পরেও অক্সিজেন পরিবহন বাবদ ১১ লাখ ২১ হাজার ৫০০ টাকা বিল উত্তোলন হয়েছে। অথচ স্পেকট্রা লিমিটিডে কর্তৃক স্থাপিত অক্সিজেন প্লান্টের সিলিন্ডারে নিজস্ব পরিবহন দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়।
টিআইবি’র সচেতন নাগরিক কমিটি’র (সনাক) জেলা সহ-সভাপতি খলিল রহমান বলেন, সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল আমাদের ভরসার জায়গা, একটা আস্থার জায়গা। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত এখানে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন কেউ কেউ। যে কারণে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, একপক্ষ এটার সঙ্গে যুক্ত। আমরা দেখছি এই সিন্ডিকেটের ব্যক্তিরাই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। অডিট প্রতিবেদন অনুসারে সরকারি বরাদ্দ দিয়ে এক বছরে প্রায় ১৮ কোটি টাকা দুর্নীতি কথা বলেছেন শিক্ষার্থীরাও। প্রতিটি বিষয়ে তদন্ত করা উচিত। যারা যুক্ত, যাদের নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এই হাসপাতাল সিন্ডিকেট মুক্ত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যারা অযৌক্তিক দাবি নিয়ে (আউটসোর্সিং) নৈরাজ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে— আমরা মনে করি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন সবাই মিলে বসে আলোচনা করে এই বিষয়টি দেখা উচিত। যারা আউটসোর্সিং স্বাস্থ্যকর্মী ছিলেন, তারাও তো এই এলাকার লোকজন। কোনো দাবি থাকলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জানাতে পারে। তারা সেবা বন্ধ করার কে? কেন লোকজনকে হয়রানি করছেন?
খলিল রহমান বলেন, হাসপাতালটিতে দালালে ভরা, এরা কারা? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সিভিল সার্জন সবাই মিলে আলোচনা করে সুন্দর, সুষ্ঠু, দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত।
অভিযুক্ত সুলেমান আহমেদ বললেন, হাসপাতালের সব টেন্ডার ই—জিপির মাধ্যমে হয়। সার্ভারে ঠিকাদারসহ সব তথ্য উন্মুক্ত থাকে। এখানে দুনীর্তি করার সুযোগ নেই। একটি পক্ষ যারা অতীতে হাসপাতালের টেন্ডার ছিনতাই করেছিল, তারাই ষড়যন্ত্র করছে।
সিল—স্টাম্পের অস্বাভাবিক বিলসহ অন্যান্য প্রসঙ্গে ডা. আনিছুর রহমান বললেন, আমার জানামতে এগুলো প্রপারলি করা হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগ সত্য নয়। ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য এটি করা হচ্ছে।
অডিট আপত্তিকে অভিযোগ হিসেবে নেওয়া যায় না মন্তব্য করে তিনি বলেন, অডিট আপত্তির জবাব আমরা অফিসিয়েলি দেব। কিন্তু এটি বাইরে যারা দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেব।
সারাবাংলা/এনইউ
২০২২-২৩ অর্থ বছর
অডিট প্রতিবেদন
অনিয়ম
দুর্নীতি
লুটপাট
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল